মুজিববর্ষে ৯ লাখ পরিবারকে বাড়ি করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপের ৭০ হাজার পরিবারকে জমিসহ পাকা ঘর করে দেয়া হয়েছে। আগামী মাসে আরও এক লাখ পরিবার পাবে এমন বাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী এ কার্যক্রম চলমান।
শনিবার প্রথম ধাপে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ৭০ হাজার পরিবারের হাতে বাড়ির কাগজপত্র হস্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে সত্যি আমার জন্য একটি আনন্দের দিন। কারণ এই দেশের যারা সবথেকে বঞ্চিত মানুষ, যাদের কোনো ঠিকানা ছিল না, ঘর-বাড়ি নেই। আজকে তাদেরকে অন্তত একটা ঠিকানা, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে পেরেছি।
তিনি বলেন, মুজিববর্ষে আমাদের অনেক কর্মসূচি ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তা করতে পারিনি। করোনা আমাদের জন্য যেমন অভিশাপ নিয়ে এসেছিল, আবার আরেকদিকে আশীর্বাদও। কারণ আমরা এই একটি প্রকল্পেই নজর দিতে পেরেছি। এটাই আমাদের আজকে বড় উৎসব; গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষদের ঘর দিতে পেরেছি। এর চেয়ে বড় উৎসব বাংলাদেশে হতে পারে না। এ সময় সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালীদের নিজ নিজ এলাকার ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর তৈরি করে দেয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
এই প্রকল্প জাতির পিতার চিন্তার ফসল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশের মানুষের জন্যই কিন্তু আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি আমাদের কথা কখনো চিন্তা করেননি। সারাজীবন চিন্তা করেছেন এই দেশের মানুষের কথা। স্বাধীনতার পরে তিনি (বঙ্গবন্ধু) মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। এই দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নানাভাবে সামাজিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দারিদ্রের কারণে ভিটেমাটি বিক্রি করে শূন্য হাতে রাস্তায় বের হয়। এইভাবে মানুষগুলো জীবনযাপন করে। তিনি (বঙ্গবন্ধু) স্বাধীনতার পরপরই গৃহহীন মানুষগুলোকে ঘর দেয়ার জন্য গুচ্ছগ্রাম পরিকল্পনা হাতে নেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) নোয়াখালীর চরাঞ্চলে গিয়ে গুচ্ছগ্রাম উদ্বোধন করেন। সাধারণ মানুষের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করার চিন্তাটা তিনিই করেছিলেন।
নিজেরও ঘর বাড়ি ছিল না দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৮১ সালে দেশে মানুষের শক্তি নিয়েই আমি দেশে ফিরে আসি। আমার কিছু ছিল না। ঘর নেই, কোথায় উঠবো তাও জানি না, কীভাবে চলবো তাও জানি না। কিন্তু তখন আমার মনে একটাই কথা ছিল আমাকে যেতে হবে। কারণ দেশের মানুষ সামরিক শাসকদের হাতে নিষ্পেষিত হচ্ছে, তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে, অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে, তার জন্য কাজ করতে হবে। এই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে, যা আমার বাবা চেয়েছিলেন। সেই আদর্শ সামনে নিয়েই আমি ফিরে আসি। কখনো আমি ছোট ফুফুর বাড়ি, মেঝ ফুফুর বাড়িতে দিন কাটিয়েছি। তখন আমার লক্ষ্য ছিল একটাই, আমি কীভাবে থাকবো সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু দেশের মানুষের কষ্ট-দুঃখ-হাহাকার কীভাবে দূর করবো, সেই কাজ করবো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিদেশ থেকে প্রণোদনা নিয়ে সাহায্য করা হতো না। এরকম দূভার্গ্যে তারা পড়েছিল, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। জাতির পিতা তো সব পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, গৃহহীনদের ঘর দেবেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে হাসপাতাল করে চিকিৎসা সেবা দিবেন। লেখাপড়ার ব্যবস্থা করবেন, মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন, এটাই ছিল জাতির পিতার লক্ষ্য। তার পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন করতে পারতো তাহলে দেশের মানুষ আরও আগে উন্নত জীবন পেতো।
আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে নৌকার জয় হয়েছিল জনগণের আন্দোলনের ফসল হিসেবে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে আমাদের লক্ষ্য ছিল দেশের খেটে খাওয়া, গবিব, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা এবং বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা। আমরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও স্বামী পরিত্যক্তদের ভাতা দেয়া শুরু করলাম। গৃহহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্প নিলাম। কারণ তখন দেখা গিয়েছিল আলাদা ঘর দিলে সেটা বিক্রি করে দিতো, শূন্য হাতে ফিরে আসতো। সেই জন্য ব্যারাক করে দিয়ে প্রত্যেককে একটি ঘরের মালিক করে দিয়ে ভূমিহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর দেয়া শুরু করলাম।
তিনি আরও বলেন, এরপর কমিউনিটি ক্লিনিক করে চিকিৎসা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় নেয়ার ব্যবস্থা করলাম। নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছি। আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন জাতি গড়ে তোলার কাজ করলাম। বস্তিবাসীদের মধ্যে যারা নিজের গ্রামে ফিরে যাবে, তাদের জন্য ঘরে ফেরা কর্মসূচি নিলাম। নিজ গ্রামে ফিরে গেলে ছয় মাস বিনা পয়সায় খাবার পাবে, বাচ্চাকে স্কুলে দিতে পারবে, বিনা পয়সায় একটা ঘর করে দিব। সেই সঙ্গে টাকা দেব যেন তারা কাজ করে খেতে পারে। এর মাধ্যমে ঘরে ফেরা কর্মসূচি শুরু করলাম।
তিনি আরও বলেন, গৃহায়ন তহবিল করি বাংলাদেশ ব্যাংকে। এই তহবিলের টাকা আমরা এনজিওদের মাধ্যমে দিলাম, তারা যেন আমাদের ভূমিহীন মানুষদের ঘর তৈরি করে দিতে পারে। এক শতাংশ সার্ভিস চার্জে টাকা দিতাম, ৫ শতাংশের বেশি তারা সুদ নিতে পারবে না, স্যানেটারি পায়খানা তারা বিনা পয়সায় করে দিবে এই শর্তে এনজিওদের দিলাম। এই প্রক্রিয়ায় ২৮ হাজার পরিবার ঘর পেয়েছিল। ১১ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের বিল্ডিং তৈরি করেছিলাম, তার মধ্যে চার হাজার চালু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিএনপি এসে তা বন্ধ করে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, ২০২০ সাল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা একইসঙ্গে পালন করে যাচ্ছি।করোনায় সারাবিশ্ব স্থবির। আজকে আমাদের ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলতে হচ্ছে। আমার খুব আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজের হাতে দাঁড়িয়ে জমির দলিল তুলে দেব। কিন্তু সেটা পারলাম না। তারপরেও ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে বলে আজকে আমি আপনাদের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারছি। আমি ধন্যবাদ জানাই, আমাদের সর্বস্তরের প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। কারণ তারা নিজেরা আন্তরিকতার সঙ্গে ঘর তৈরিতে কাজ করেছেন। আমার অফিস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রতিনিয়ত তদারকি করেছে, যাতে ঘরগুলো মানসম্মত হয়, কাজগুলো ঠিকমতো হয়।
একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঘর দেয়ার নজির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এত দ্রুত সময়ে আমি জানি না, পৃথিবীর কোনো দেশে কখনো অথবা আমাদের দেশে কোনো সরকার এত দ্রুত এতগুলো ঘর করেছে। এই ঘরগুলো তৈরি করা সহজ কথা নয়। যেহেতু আমাদের যারা প্রশাসনে আছেন তারা সরাসরি ঘরগুলো তৈরি করেছেন, তাতে ঘরগুলো মানসম্মত হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা সবসময় আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে। সেই সঙ্গে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান হতে শুরু করে সব জনপ্রতিনিধি সহযোগিতা করেছে। এই একটি কাজে আমরা দেখেছি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দায়িত্ব পালন করেছেন। এবং সকলেই এই অসাধ্য কাজ সাধন করেছেন। এছাড়া সব শ্রেণীর মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। যাতে সবাই মানসম্মতভাবে বাঁচতে পারে।
শেখ হাসিনা বলেন, মুজিববর্ষে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি মানুষও গৃহহীন, ঠিকানাবিহীন ও গৃহহারা থাকবে না। হয়তো আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। তাই আমরা সীমিত আকারে করে দিচ্ছি। সব মানুষের জন্য ঠিকানা আমরা করে দেব। কারণ আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষ ঘরে থাকলে আমার বাবা-মা যে ত্যাগ শিকার করেছিলেন এই দেশের মানুষের জন্য। তাতে তাদের আত্মা শান্তি পাবে। আজকে আমরা সবচেয়ে খুশি এত অল্প সময়ে এতগুলো মানুষকে ঠিকানা দিতে পারছি। এই শীতের মধ্যে এই সব মানুষ ঘরে থাকতে পারবে।
তিনি বলেন, আমাদের রিফিউজিদেরকে ভাসানচরে ঘর করে দিচ্ছি। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকার সময়ে ঘূর্ণিঝড়ে যে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেই কক্সবাজারে খুরশকুলে ঘর করে দিয়েছি। আরও ১০০ বিল্ডিং তৈরি করে দেব। আজকে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘর তৈরি করে দিয়েছি। আরও ১ লাখ ঘর তৈরি করবো।
উদ্বোধন শেষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপকারভোগীদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা থেকে ঘর পাওয়া পারভীন নামে এক নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করেন এবং সুস্থতা কামনা করেন।
পারভীন ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমার স্বামী কাজ পায় না। মাঝে মধ্যে না খেয়ে থাকতে হয়। মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। কোনোদিন ভাবিনি ঘর হবে। আপনি আমাদের ঘর দিয়েছেন, জমি দিয়েছেন। আপনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন। কয়েকটি বাক্য বলেই উপকারভোগী এ নারী কৃতজ্ঞতায় কাঁদতে থাকেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, আপনি কাঁদবেন না। আমি মনে করি, এটা আমার কর্তব্য। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, জাতির পিতার কন্যা হিসেবে দেশের মানুষের জন্য কাজ করবো, এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার স্বপ্ন পূরণ করবো। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে সেজন্য আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করেছি। বাংলাদেশে একটি মানুষও যেন গৃহহীন ও ভূমিহীন না থাকে আমি সেই ব্যবস্থা করবো। সেই সঙ্গে আপনারা যেন আপনাদের জীবন-জীবিকার পথ খুঁজে পান সেই ব্যবস্থাও করবো।
সারাদেশে যারা ঘর পেয়েছেন তাদেরকে ঘরের সামনে একটি করে গাছ, বিশেষ করে ফলজ গাছ লাগানোর আহ্বান জানান তিনি। নদী ভাঙণে যাতে আর কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মুজিববর্ষ ঘোষণা করে সরকার। মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না- এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে চলমান কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ে সারাদেশে ৭০ হাজার ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার বাড়ি পেয়েছে। দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর করে দিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ পরিবারকে তালিকাভুক্ত করেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পে। ধাপে ধাপে তাদেরও বাড়ি করে দেয়া হবে।