আলজাজিরার ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

আলজাজিরা

সম্প্রতি কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরায় বাংলাদেশের ওপর করা প্রামাণ্যচিত্রটি বারবার দেখার পর এটাই মনে হচ্ছে, প্রামাণ্যচিত্রের নামে এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ তৈরির পিছনে রাষ্ট্রবিরোধী দেশীয় ও বিদেশী শক্তি জড়িত আছে; যারা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ঈর্ষান্বিত এবং এ দেশকে অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে অগ্রযাত্রার ক্রমবর্ধমান ধারাকে থামিয়ে দিতে চাই। তাদের উদ্দেশ্য হলো—আংশিক সত্যের সঙ্গে মিথ্যার মিশ্রণে কাল্পনিক প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক জনগণের মধ্যে প্রপাগাণ্ডা (ষড়যন্ত্র তত্ত্ব) প্রচার করা। আর এসবের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে, বেআইনিভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা।

আলজাজিরার প্রামাণ্যচিত্রটির (ষড়যন্ত্র তত্ত্ব) নীলনকশা তৈরি করেছেন ড. কামাল হোসেনের মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী ডেভিড বার্গম্যান। বার্গম্যান নামটাই যেন একটি মিথ্যাচার। সাংবাদিক নামের এই ভাড়াটিয়া বাংলাদেশের মতো দেশে এসে এদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে রিপোর্ট করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান নষ্টের অপপ্রায়াস চালিয়েছেন, এদেশের আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন। কাজেই এই কুখ্যাত বার্গম্যান যখন কোনো সাংবাদিকতা প্রকল্পে যুক্ত হন তখন সেটা যে আর সাংবাদিকতা থাকে না তা সচেতন মহলের সবারই জানা। তখন সেখানে সাংবাদিকতার পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা এবং ভাড়ায় খাটা ফরমায়েসই প্রাধান্য পায়। সেটাই হয়েছে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ নামের প্রামাণ্যচিত্রটিতে।

তথ্যচিত্রটি দেখার শুরু থেকেই এটির বিষয়বস্তু, বস্তুনিষ্ঠতা এবং রাজনৈতিক মতলব নিয়ে আমার খটকা লেগেছে। এই খটকার শুরুটা প্রামাণ্যচিত্রটির নাম নিয়েই। ১৯৭৬ সালে ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স মেন্’ নামে হলিউডে একটি বিখ্যাত মুভি তৈরি হয়েছে। বহুল আলোচিত এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে, যে ঘটনার প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তার সঙ্গে মিল রেখে এই নাম কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য? ‘আহমেদ ব্রাদার্স’-এর কাহিনীতে প্রধানমন্ত্রী কীভাবে আসেন এবং কীভাবে তারা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ হন তার কোনো প্রমাণ কিংবা ব্যাখ্যা নেই পুরো ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’জুড়ে।

আলজাজিরায় সেনাপ্রধানের ভাইকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেছেন বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু জেনারেল আজিজের ভাই-ই যে শুধু রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করেছেন, বিষয়টি এমন নয়। বহু বছর আগে জিয়াউর রহমান সাত খুনের জন্য সাজাপ্রাপ্ত শফিউল আলম প্রধানকে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রথম ক্ষমা করেছিলেন। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রপতি বহুজনকে ক্ষমা করেছেন। সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে এই বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে। এই জন্য যে তিনি সব কিছু বিবেচনার পর যদি মনে করেন বিচারে কোনো ত্রুটি থেকে থাকতে পারে, তাহলে ন্যায়ের স্বার্থেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারেন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই বিধান রয়েছে।

জেনারেল আজিজের ভাই হারিস তাঁর ভাইয়ের নাম ভাঙিয়ে, তাঁর অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন বলে যে কথা আলজাজিরায় বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। কেননা এই দাবির পক্ষে তারা ন্যূনতম প্রমাণ দিতে পারেনি। তারা এক ব্যক্তিকে হাঙ্গেরির এক কর্মকর্তা বলে উপস্থাপন করেছে। অথচ ওই ব্যক্তি যে সত্যি সত্যিই হাঙ্গেরিয়ান কর্মকর্তা, তার পক্ষে সমর্থনসূচক কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার এবং উন্নয়নের জন্য তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশ চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। কোনো অবস্থায়ই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। অথচ আলজাজিরা প্রতিবেদনটিতে এই মর্মে ভুয়া কথা বললো যে বাংলাদেশ নাকি ইসরায়েল থেকে গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি কিনছে। অথচ তাদের তথ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে হাঙ্গেরি থেকে।

মিথ্যা সংবাদ প্রচারের কারণে আলজাজিরার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছে সৌদি আরব, মিসর, বাহরাইন, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ। এই চ্যানেলটি যে জঙ্গি মৌলবাদী সংস্থা ইসলামিক ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা-ও কারো অজানা নয়। সুতরাং মৌলবাদ প্রচার করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে অসাংবিধানিকভাবে সরকারের পতন ঘটানোর ক্ষীণ উদ্দেশ্যেই তাদের এ অপপ্রয়াস। আমরা মনে করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে-বিদেশে যে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম ও গণতন্ত্রের প্রতি একনিষ্ঠতার কারণে, সেটা আলজাজিরার ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষুণ্ন করতে পারবে না।

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা,
সিনিয়র সাব-এডিটর, মত ও পথ।

শেয়ার করুন