প্রয়োজন সমাজ বদলের আন্দোলন ।। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একুশের সংকলন আর বের হয় না, প্রভাতফেরিও থেমে গেছে। গেণ্ডারিয়ার সীমান্ত পাঠাগারের কিংবা মহিলা সমিতির সদস্যরা ভোর ৫টায় রওনা হয়ে গান গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে আসছে, এমন দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। গেণ্ডারিয়া ও শহীদ মিনার কি অনেক দূরে সরে গেছে পরস্পর থেকে? তারা তো সেখানেই আছে যেখানে ছিল; তবে হ্যাঁ, মাঝখানের দূরত্বটা সত্যি সত্যি বেড়ে গেছে। দুইয়ের মাঝখানে অনেক গাড়ি-ঘোড়া এখন, গেণ্ডারিয়া থেকে পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে আসা খুবই কঠিন, কোনোমতে এলেও ফিরে যাওয়া অসম্ভব। পদে পদে যানজট। মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অনেক গুণ। পরিবেশ সত্যি সত্যি বৈরী।

তা পরিবেশ তো আগেও বৈরীই ছিল। রাষ্ট্র তো পক্ষে ছিল না সংকলনের, পক্ষে ছিল না প্রভাতফেরির। সরকারি ভ্রুকুটি অস্বীকার করেই পথে পা বাড়াত তরুণ। আরেক তরুণের কথা মনে পড়ে আমার। শহীদ হয়েছে সে একাত্তরে। সে সাহিত্য সম্পাদক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের। বিজ্ঞানের ছাত্র। অত্যন্ত প্রাণবন্ত। আমার কাছে এসেছিল একটি লেখা চাইতে। একুশে সংকলন বের করবে হল ইউনিয়নের পক্ষ থেকে। এমনভাবে বলেছিল যে লেখা না দিয়ে উপায় ছিল না আমার। সংকলন বের হলো ২০ তারিখে। ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সে কপি দিয়ে গেছে আমাকে, বাসায় এসে। সংকলনের নাম কী ছিল? বোধ হয় রক্তপলাশ। ছেলেটির নাম? চেহারা মনে আছে, নামটা পুরো মনে নেই। জাফর বলে স্মরণে আসে, পুরো নামটা এখন দেখছি মনে করতে পারছি না। জাফর সাদেক হতে পারে। ২৫ মার্চের রাতে সে ছাত্রাবাসে ছিল। বাড়ি তার কক্সবাজারে। সেখানে যায়নি। ঢাকায় ছিল, আন্দোলনে ছিল। ওই রাতে তার আবাসিক হলে পাকিস্তানি হানাদাররা যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল তাতে শহীদ হয়েছে সে।

universel cardiac hospital

এই চরম শত্রুতাময় পরিস্থিতিতেও কাজ করেছে তরুণ। বিপদকে বিপদ মনে করেনি। প্রস্তুত ছিল যেকোনো ত্যাগে। কিন্তু এখন এসেছে হত্যা ও আত্মহত্যার যুগ। এখনকার তরুণ পথ পায় না, পদে পদে মৃত্যুর দিকে এগোয়। আমাদের দেশ শৈশব ও বার্ধক্যের দেশ, এখানে তরুণ বড়ই বিপদগ্রস্ত। তবু তরুণরা জীবন্ত ছিল, যখন দেশে আন্দোলন ছিল। এখন আন্দোলন নেই, প্রবাহ নেই, এখন চতুর্দিকে শুধু নর্দমা ও পচা ডোবা। কিলবিল করে কীটপতঙ্গ। জাফর সাদেকদের ছাত্রসংগঠনটি এখনো আছে; কিন্তু তারা আন্দোলন করে না, চাঁদাবাজি করে। ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নামে। নিজেদের মধ্যেও লড়াই-সংগ্রাম বাধায়। নিহত হয়। আন্দোলন যে করবে সেটা কার বিরুদ্ধে, কার পক্ষে? পাকিস্তানের কালে আন্দোলন করত শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, করত বাংলা ভাষার পক্ষে, করত আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে। এখন? রাষ্ট্র এখন নিজেদের, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়ে গেছে। এখন কার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে সে? শত্রু কে? শত্রুর তো সন্ধান পাওয়া যায় না। অথচ শত্রু নিশ্চয়ই আছে। নইলে কেন এই আত্মহত্যা, কেন এই তারুণ্যনিধন? কে করছে? করছে একটা ব্যবস্থা। ওই ব্যবস্থাটাই আসল। সেটি পাকিস্তানের কালে ছিল, এখনো আছে। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের মালিক, তার সৈন্য-সামন্ত, আইন-পুলিশ সব কিছুই ছিল ওই ব্যবস্থার প্রকাশ। ব্যবস্থাটা ছিল আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। নতুন রাষ্ট্র পেয়েছি আমরা, এখনকার শাসকরা বাংলায় কথা বলে, বাংলা ভাষা এখন রাষ্ট্রভাষা, সবই সত্য; কিন্তু ওই যে আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, সেটার তো মৃত্যু হয়নি। পরিবর্তনও ঘটেনি, সে আছে বহাল তবিয়তে এবং যেহেতু তাকে চিনতে কষ্ট হয়, তাই আছে সে নিরুপদ্রবে। তার এখন পোয়াবারো। সে-ই হত্যা করছে, আত্মহত্যা ঘটাচ্ছে। তরুণ এখন বিপন্ন।

সংকলনগুলো এখন নেই। কিন্তু তরুণ তো আছে, তার তারুণ্যও রয়েছে। আছে তার আকাঙ্ক্ষাও। তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষা সে দুঃসাহসিক কাজ করবে, প্রতিবাদ করবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সেই আকাঙ্ক্ষাটা চরিতার্থ করার উপায় নেই। আন্দোলন নেই দেশে। অথচ আন্দোলন ভীষণভাবে দরকার; আন্দোলন দরকার ওই বৈরী ব্যবস্থাকে বদলাবার জন্য। আন্দোলন দরকার মানুষকে মুক্ত করার জন্য। এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার চেয়ে বীরত্বপূর্ণ কাজ আর কী হতে পারে?

ওই কাজ তরুণ অতীতে করেছে। করেছে ব্রিটিশের কালে। ব্রিটিশকে তাড়াবার জন্য পথে নেমেছে। করেছে তা পাকিস্তানের কালে। তখন সে রাজপথে ছিল পাকিস্তানিদের তাড়াবার লক্ষ্যে। কাজ আজও সে করতে চায়। চায় নিজে মুক্ত হবে, সেই সঙ্গে সবাইকে মুক্ত করবে। কিন্তু পথ পায় না। তাকে ডাকবে এমন সংগঠন নেই। তার সামনে এসে দাঁড়াবে এমন নেতৃত্ব নেই।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনে অনেকেই উল্লসিত হয়েছিলেন। না বুঝে এবং মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে। বোঝেননি যে ওটি সমাজতন্ত্রের পতন নয়, পতন সমাজতন্ত্রের একটি পরীক্ষার। ওই পরীক্ষা বলে দিয়েছে, সমাজতন্ত্রের শত্রু শুধু বাইরে থাকে না, ভেতরেও থাকে। মানুষ হচ্ছে একটি স্বার্থপর প্রাণী, তার মধ্যে আত্মত্যাগের ইচ্ছাও থাকে; কিন্তু সেটা আসবে স্বার্থপরতাকে অতিক্রম করে, বস্তুত নিজের স্বার্থ এবং অন্য সবার স্বার্থ যে এক ও অভিন্ন এই বোধ থেকে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে একটি গোষ্ঠী আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সে জন্যই ওই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি টিকল না। আমলাতন্ত্র বাইরে থেকে শত্রুকে ডেকে নিয়ে এলো, এনে নিজের স্বার্থ, সবার স্বার্থকে বিপন্ন করল। আজ সবার বিপন্নদশাটি সেখানে অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে। তরুণ সেখানে পথহারা, মেয়েরা সেখানে বিপন্ন।

বাংলাদেশে জীবনযাপন ক্রমাগত কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। রক্ষা পাওয়ার উপায় বিদেশি ঋণ নয়। গরিব মানুষকে ঋণ দিতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে উন্নতি করতে উদ্বুদ্ধ করাও নয়, উপায় হচ্ছে যে ব্যবস্থা দারিদ্র্য সৃষ্টি করছে তাকে বদলানো। সমাজ বদলের সেই আন্দোলন গড়ে উঠলে প্রয়োজনে তরুণ প্রাণ দেবে। যেমন অতীতে সে দিয়েছে। ওই আন্দোলন ছাড়া তরুণ বাঁচবে না, আমরাও বাঁচব না।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন