২০০৪ সালের ১ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোতে ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত–ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ শীর্ষক সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা প্রকাশিত হয়। তখন আবুল মকসুদ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক ছিলেন। এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আবুল মকসুদকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকারে সৈয়দ আবুল মকসুদ বাসস থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর সেই লেখাটি মত ও পথ পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো
হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত—ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ: সৈয়দ আবুল মকসুদ
শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঈশ্বরদীতে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের মনোরম চত্বরে পায়চারি করে রেস্টহাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় অনুজ কবি মজিদ মাহমুদ ম্লানমুখে বললেন, স্থানীয় ‘নোঙর’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হাসানুজ্জামান ফোনে জানিয়েছেন যে ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় হুমায়ুন আজাদ গুরুতর আহত হয়েছেন। ‘গুরুতর’ শব্দটির আজকাল প্রায়ই অপপ্রয়োগ ঘটে। সুতরাং হুমায়ুন আজাদ গুরুতর আহত না হয়ে যদি কোনো মনুষ্যরূপী পশুর হাতে অতি মৃদু আহতও হয়ে থাকেন তাতেও আমাদের বুকে লাগবে প্রচণ্ড আঘাত। শুক্রবার সারাটা দিন খুবই আনন্দে কেটেছে। নোঙর সাহিত্যগোষ্ঠীর লেখক সম্মেলন উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিলেন হাসান আজিজুল হক, জুলফিকার মতিন, অনীক মাহমুদ প্রমুখ। হুমায়ুন আজাদের দুঃসংবাদ শুনে রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে গেল। সকালের ঢাকার সংবাদপত্রের প্রতীক্ষায় রইলাম। শনিবার সংবাদপত্রে যা জানলাম তা অচিন্ত্যনীয়। তবে এ কথা আর একবার প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশে আজ কোনো কিছুই অবিশ্বাস্য নয়-অসম্ভব নয়।
হুমায়ুন আজাদ এমন বীভৎসভাবে, বর্বরোচিতভাবে আহত হতে পারেন তা প্রাথমিক সংবাদ শোনার পর আমার মাথায় আসেনি। হুমায়ুন আমাদের বন্ধু কিনা, তার সঙ্গে ১৯৬৩তে প্রথম পরিচয় কিনা ঢাকা কলেজের বারান্দায়, সে প্রশ্ন এই পরিস্থিতিতে বড় নয়। আমাদের দেশের একজন চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল লেখক পশুশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, একজন মতামত প্রকাশকারীর শরীরে নৃশংসতমভাবে আঘাত হানা হয়েছে, সে প্রশ্নই আজ বড়।
গত ৪১ বছরে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আমার বহু সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা কেটেছে। তবে আজকাল দেখাশোনা ও আড্ডা হয় খুবই কম। যেমন গত সাত-আট মাসে তার সঙ্গে দেখাই হয়নি। দুমুর্খ বলে তার পরিচিতি। কিন্তু হুমায়ুন তো চিরকাল দুমুর্খ ছিলেন না, স্পষ্টভাষী ছিলেন। দুমুর্খ তাকে করেছে এই নষ্ট সমাজ, এই অসহনীয় নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
আমরা যারা ষাটের দশকের লেখক, কবি, সংস্কৃতিকর্মী প্রভৃতি তারা একটি বিশ্রী বৈষম্যমূলক ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেড়ে উঠেছি বলে আমাদের সকলের চোখে ও বুকে একটি স্বপ্ন ছিল। আমরা চেয়েছিলাম একটি মোটামুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ যেখানে সকল মানুষের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলেও ধর্মান্ধতা থাকবে অনুপস্থিত। কিন্তু সীমাহীন রক্তের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও, আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র থেকে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা বিন্দুমাত্রও দূর করতে পারিনি। বরং ৩২ বছরে তা বাড়তে বাড়তে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার ঘৃণ্যতম প্রমাণ ও উদাহরণ হুমায়ুন আজাদের ওপর এই সন্ত্রাসী আক্রমণ।
কাগজপত্রে বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে প্রাথমিক শর্ত- মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ও সিভিলিটি, ভিন্ন মতাবলম্বীর প্রতিও সৌজন্যবোধ-তার লেশমাত্র এ দেশে অনুপস্থিত। সভ্যতা ও গণতন্ত্রের শত্রুরা অবশ্য হুমায়ুন আজাদের প্রতি চরম আঘাত হেনেছে কিন্তু প্রায় অনুরূপ আঘাত হানা হচ্ছে অগণিত ভিন্ন মতাবলম্বীর ওপর প্রতি মুহূর্তে দেশজুড়ে। ফ্যাসিবাদ আর গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। কিছুটা ফ্যাসিবাদ কিছুটা গণতন্ত্র-এ রকম কোনো ককটেলও গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সেই দুর্বিষহ অবস্থায়ই রয়েছি।
প্রতিপক্ষের, বিশেষ করে বিরোধী দলের বা সরকারপন্থি নয় এমন মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের ওপর অব্যাহতভাবে কিছুকাল যাবৎ আক্রমণ চালানো হচ্ছে। গত বুধবার আমাদের জোট সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের অতি প্রিয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর যে ‘মানবাধিকার রিপোর্ট’ প্রকাশ করেছে তাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের ওপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। ভোলায় শেখ হাসিনার বক্তৃতা মঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া তিনি যখন দক্ষিণাঞ্চলে সফরে যাচ্ছিলেন তখন তার নানা জায়গায় পথসভায় ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। সে জন্য তৈরি মঞ্চগুলো তছনছ করা হয়েছে। কালকিনি, গৌরনদী, উজিরপুর প্রভৃতি স্থানে শেখ হাসিনার বক্তৃতার মঞ্চ ভেঙে দিয়েছে সরকারি দলের লোকজন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ড. কামাল হোসেনের ওপর হামলা হয়েছে। তার অবস্থাও হুমায়ুনের মতোই হতে পারত। শুধু শেখ হাসিনা বা কামাল হোসেনের ওপর নয় সরকারবিরোধী যেকোনো সভা-সমাবেশের ওপরই প্রতিদিন নানা জায়গায় আক্রমণ চলছে এবং এগুলো করছে সরকারি দলের লোকরাই। এর পরও আমাদের দিয়ে জোর করিয়ে বলানো হবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র?
সরকারবিরোধী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে চাইছে বিএনপি-জামায়াত জোট। মানবজাতির ইতিহাসে এই কর্মটি কোনো দেশে কোনো সরকার পারেনি। বর্তমান নির্বাচিত সরকার যা করছে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারও তেমন ফ্যাসিবাদী আচরণ করেনি তার বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি। এই জোট সরকার বেমালুম ভুলে গেছে চৌদ্দ কোটি মানুষের জীবন ও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার গত নির্বাচনে ৩৫/৪০ শতাংশ জনগণও তাদের দেয়নি। যে অঙ্গীকার করে জনগণের থেকে তারা ভোট আদায় করেছিলেন তার প্রত্যেকটি অঙ্গীকার তারা বরখেলাপ করছেন। সুতরাং জনগণ এ অবস্থা বরদাশত করতে পারে না।
ঈশ্বরদী থেকে ফিরেই আমি তাৎক্ষণিকভাবে এ লেখাটি লিখছি। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালেও যাওয়া হয়নি। এ মুহূর্তে আমি আবেগাপ্লুত- আমার চোখে ভাসছে হুমায়ুনের মুখ। চোখে ভাসছে ভাবী, ওর কন্যাদ্বয় ও পুত্রের বিপন্ন মুখ। হুমায়ুনের ওপর হামলা ব্যক্তি হুমায়ুন আজাদের ওপর নয়-এ আঘাত যেন স্বাধীন মত প্রকাশকারী প্রত্যেকটি মানুষেরই ওপর। সে জন্যই হুমায়ুনের বন্ধু-অবন্ধু সবাই আজ ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ ও মর্মাহত।
আমাদের রাষ্ট্র অপরাধীদের বিচার করে না, নিরপরাধীকে নানা উপায়ে বিপন্ন করে। আমাদের দাবি হুমায়ুন আজাদের আক্রমণকারীদের প্রশাসন খুঁজে বের করবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে। তার আগে এই মুহূর্তে আমাদের দলমত নির্বিশেষে সকলের কর্তব্য তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং তাকে যত শিগগির সম্ভব নিরাময় করে তোলা। আমাদের প্রার্থনা-কবি হুমায়ুন আজাদ শুধু বেঁচে উঠুন তা নয়, অতি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক।