রয়টার্সের বিশ্লেষণ : যুবরাজকে তার ‘জায়গায়’ রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান- জামাল খাসোগি।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান- জামাল খাসোগি। ফাইল ছবি

সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে সরাসরি কোনো সাজা দিচ্ছে না মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। যদিও এই হত্যা পরিকল্পনায় তার সবুজ সংকেত ছিল বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।

তবে তিনি যে একেবারে অক্ষত থাকছেন–বিষয়টি তেমনও না। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশ্লেষণ এ কথাই বলছে।

universel cardiac hospital

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, খাসোগিকে ধরে নিয়ে যাওয়া কিংবা হত্যায় যুবরাজের অনুমোদন ছিল।

২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে ওয়াশিংটন পোস্টের এই সাংবাদিককে হত্যা করে তার গুপ্তচরেরা। এরপর তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে রাসায়নিক দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিবেদনটি প্রকাশে অস্বীকার করলেও বাইডেন তার উল্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে সৌদির মানবাধিকারের রেকর্ড ও অস্ত্র ক্রয়ের প্রলোভনকে ঘিরে ওয়াশিংটনের অবস্থানের প্রতি নতুন করে আলোকপাত করা হয়েছে।

সৌদির কার্যত শাসক যুবরাজের–পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত এমবিএস নামে–দিকে প্রকাশে আঙুল তুলে তার সঙ্গে সরাসরি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া পশ্চিমা মিত্রদের জন্য কঠিন করে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

ওয়াশিংটন যখন ৩৫ বছর বয়সী যুবরাজের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে চাচ্ছে, তখন ইরানের বিপরীতে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় পুরনো আরব মিত্রটির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায়ও জোর দিচ্ছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকিন সেই আভাসই দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা যা করেছি—সৌদির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ না—বরং আমাদের স্বার্থ ও মূল্যবোধের আলোকে সম্পর্ক পুনর্গঠন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলাম শিক্ষার বিভাগের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো এলিজাবেথ কেনডেল বলেন, মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন সৌদির জন্য চরম লজ্জাজনক। এমবিএসের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইলে কীভাবে রাখবে; তা নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য নেতারাও এখন বিরূপ অবস্থায় পড়ে গেছেন।

খাসোগি হত্যায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এ ঘটনায় গত বছর আট জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

সৌদি আরবের কার্যত শাসক হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিজের ওপরই বর্তায় বলে জানিয়েছেন যুবরাজ। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীসহ ৭৬ জনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রেহাই দেওয়া হয়েছে এমবিএসকে।

তবে সৌদি আরবের মানবাধিকার আরও বিস্তৃতভাবে পর্যবেক্ষণের আভাস দিয়েছেন বাইডেন।

উপসাগরীয় দেশটিতে যুবরাজের নেতৃত্বে ভিন্নমতাবলম্বীদের ধরপাকড়, কোণঠাসা ও কারাবন্দি করে রাখা হচ্ছে। নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে নিপীড়ন থেকে ঘনিষ্ঠ স্বজনদেরও রেহাই দিচ্ছেন না তিনি।

শুক্রবার বাইডেন বলেন, বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে ফোনালাপে তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন, রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যা গ্রহণযোগ্য না এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ইতিমধ্যে বিচার স্থগিত করে মার্কিন নাগরিক দুই সৌদি রাজনৈতিক কর্মীকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় বছর তিনেক কারাভোগের পর মানবাধিকার কর্মী লাজিন আল-হাজলুল মুক্তি পেয়েছেন।

তার ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করা হলেও সৌদি কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করছেন। মূলত বাইডেনের প্রশাসনের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের অংশ হিসেবেই সৌদি এমন উদ্যোগ নিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

বাইডেন যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছেন সৌদির প্রধান শাসকের সঙ্গে, তার উত্তরসূরি কারো সঙ্গে না। বাদশাহকে ফোন দেওয়ায়ই সেই ইচ্ছার জ্বলন্ত প্রমাণ।

রিয়াদের এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাপ্য না—এমন মর্যাদা তাকে দিয়েছিলেন ট্রাম্প প্রশাসন। অথচ, সেই সম্মান তার জন্য উপযুক্ত ছিল না। কাজেই তার যেখানে থাকার কথা—সেখানে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার এখনই সময়।

মানবাধিকার ইস্যুতে উদ্বেগ দেখা দিলে এসব কিছু ছাড়িয়ে নিজেদের সবচেয়ে বড় ক্রেতার কাছে অস্ত্র বিক্রি বাতিলের আভাস দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। ভবিষ্যৎ চুক্তি কেবল ‘প্রতিরক্ষামূলক’ অস্ত্রের মধ্যেই সীমিত করে দেওয়া হবে।

ইরান-সমর্থিত হুতিদের ওপর থেকে ট্রাস্পের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন বাইডেন। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইয়েমেনের সৌদি সমর্থক সরকারকে উৎখাত করে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

এরপর থেকৈ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ চলছে। এতে দুর্ভিক্ষের কিনারে পৌঁছে গেছে ইয়েমেন। মানবিক বিপর্যয়ও চরমে।

কিন্তু সৌদি আরবের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে বাইডেন প্রশাসন সতর্কতার সঙ্গে সামনে পা ফেলছে। বাদশাহ সালমানের বয়স এখন ৮৫ বছর। শরীরিকভাবেও তিনি নাজুক। সম্ভবত তার সন্তানই বিশ্বের শীর্ষ তেল রফতানিকারক দেশটির সিংহাসনে বসবেন।

পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সেই বিষয়টি মাথায় রাখতে হচ্ছে। এছাড়া কয়েক দশক ধরে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন মিত্রের ভূমিকা রাখছে সৌদি।

থিংকট্যাংক চাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো নেইল কুইলিয়াম বলেন, মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সৌদির জোরালো তিরস্কার আছে। কিন্তু তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক আগের মতোই থাকবে—সৌদির প্রধান নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা যোগানদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

পূর্ব ও পশ্চিমের দুই দেশের মধ্যে ১৯৪৫ সালে জোট গড়ে ওঠে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংলিন ডি. রুজভেল্ট একটি যুদ্ধজাহাজে বাদশাহ আবদুল আজিজের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সৌদির তেলের বিনিময়ে সামরিক সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন।

উপসাগরীয় অঞ্চলের এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, যুবরাজকে দোষী করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরেও তাদের পারস্পরিক স্বার্থ ঝুঁকিতে পড়বে না।

শেয়ার করুন