গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতেও কমলাপুর মহল্লাটি সবুজভরা গ্রামের মতোই, রোমান্টিক মনকে খুব টানে। একদিকে এর আধা শহুরে রূপ সীমিত পরিসরে, সে পরিসরের বাইরে ফুলকপি-বাঁধাকপি, লাউ-ডাঁটাসহ সবজি চাষের শ্যামল সমারোহ, মাঝেমধ্যে দু-চারটে কাঁচা-পাকা বাড়ি। আমি সবে এখানে আশ্রয় নিয়েছি, এর রূপে মুগ্ধ।
কিন্তু সামরিক শাসন যেমন অনেক কিছু ভাঙে—বাঞ্ছিত বা অবাঞ্ছিত তাড়নায়, তেমনি আইয়ুব খাঁর সামরিক শাসনে বাংলাপ্রেমী গভর্নর লে. জে. আযম খানের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এসে পড়ে শহরের বাইরে সুদর্শন রেলস্টেশনের যাত্রা—কমলাপুর হয়ে ওঠে সে যাত্রার লক্ষ্য। ছোট্ট মহল্লা—স্থানান্তরে অসুবিধা কী? তালতলায় তাকে নির্বাসনে বা নয়া অবস্থানে পাঠানো যায়। উত্তর-পশ্চিমে কবি জসীমউদ্দীনের বাড়িসহ মহল্লার অংশবিশেষ ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়।
আসলে স্থান নির্বাচনটি সঠিক ছিল না। কারণ স্থানটি শহুরে মহল্লা, শহরের বাইরে না। সামান্য পুবে গেলে মুগদাপাড়ার খোলা মাঠ—স্টেশন স্থাপনার জন্য সঠিক স্থান হতে পারত। আমাদের পূর্ত মন্ত্রণালয় ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এজাতীয় চিন্তায় প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটায়নি। কাজেই কমলাপুরের বুকেই নতুন ঢাকা রেলস্টেশন ‘কমলাপুর স্টেশন’ নামে স্থাপিত হলো। কমলাপুর মহল্লা উচ্ছেদের শিকার। মহল্লাবাসীর সঙ্গে আমারও স্থানান্তর সবুজের প্রাকৃত সৌন্দর্য থেকে। অবশ্য মূল মহল্লাবাসীদের সঙ্গে নয়, অন্যত্র। ভাড়াটের আবার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কী? ঢেউয়ের টানে ভেসে চলাই তার একমাত্র নিয়তি। অতএব আমি আরামবাগে, যদিও আরামে নয়।
দুই.
সে অনেক আগের কথা। সুদর্শন স্থাপত্যের নিদর্শন কমলাপুর রেলস্টেশনে এরপর একাধিকবার যেতে হয়েছে। দু-একবার দু-একজন ভারতীয় বন্ধুকে নিয়ে। ওরা স্টেশনটির নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ হয়েছে। এটি চালু হয় ১৯৬৮ সালে। সময় ও উন্নয়নের ধারায় কমলাপুর মহল্লার মতো সুদর্শন কমলাপুর রেলস্টেশনটিও নাকি এখন ভাঙনের শিকার, অধিকতর আধুনিকতার টানে।
কিন্তু এই ভাঙন নিয়ে এরই মধ্যে ভিন্নমত প্রকাশ পেতে শুরু হয়েছে। এর আগে ঢাকায় একাধিক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন (কখনো ভবন) ভাঙা হয়েছে, ঐতিহ্য সচেতনতার প্রশ্নে যা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছে সাংস্কৃতিক-নান্দনিক প্রশ্নে। তেমনি এই রেলস্টেশন ভাঙা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন, চলেছে সমালোচনা, যেমন সাংবাদিক মহলে, তেমনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।
একটি দৈনিকে সংবাদ শিরোনাম : ‘ব্যবসার স্বার্থে ভাঙা পড়বে কমলাপুর স্টেশন’। বলা হয়েছে : ‘এটি ভেঙে ৮০০ কোটি টাকায় ‘মাল্টি মোডাল হাব’ নির্মাণে জাপানের একটি কম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারা সেখানে কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করবে। এর মধ্যে থাকবে একটি পাঁচতারা হোটেল, শপিং মল, অফিস কমপ্লেক্স ও আবাসিক ভবন। এর জন্য ভাঙা পড়বে ৫৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী কমলাপুর রেলস্টেশন।’
পাঁচতারা সংস্কৃতির এমনই মহিমা। রাজধানী ঢাকা গত কয়েক দশক ধরে পাঁচতারা সংস্কৃতির ভালো-মন্দের, এমনকি নীতি-নৈতিকতা বিগর্হিত দূষণেরও শিকার। আমাদের প্রশ্ন : উল্লিখিত আধুনিক কেতার বিচরণকেন্দ্রগুলো তো যেকোনো স্থানেই তৈরি করা যায়—যেমন এরই মধ্যে কয়েকটি গড়ে উঠেছে। উঠেছে বসুন্ধরা থেকে পূর্বাচলের মতো দর্শনীয় আবাসিককেন্দ্রগুলো। এর জন্য সুদর্শন স্থাপত্যের কমলাপুর রেলস্টেশন ভাঙা কেন? ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য তো জায়গার অভাব নেই মূল রাজধানীর বাইরে।
স্বভাবত আরো একটি দৈনিকে যুক্তিসংগত প্রশ্ন : ‘কমলপুর রেলস্টেশন কেন ভাঙা হবে? এ প্রতিবেদনে বিষয়টি একটু ভিন্নমাত্রায় পরিবেশিত। এখানে বলা হয়েছে যে মেট্রো রেলের দৈর্ঘ্য বাড়াতে এবং আনুষঙ্গিক প্রয়োজনে কমলাপুর স্টেশন ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিতে চায় রেলপথ মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ; কিন্তু মেট্রো রেলের বাস্তবায়ন সংস্থা মনে করে, তাদের প্রকল্পের জন্য কমলাপুর স্টেশন ভাঙার কোনো প্রয়োজন নেই।
এই ভিন্নমতে যে যার পক্ষে যুক্তি জুগিয়ে চলেছে, যা একটি বিতর্কিত সমস্যা তৈরি করে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি পৌঁছে গেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত। অবাক কাণ্ড, যাদের সম্পদ এই সুন্দর স্থাপত্যের প্রতীক, তারাই এটি ভাঙতে মরিয়া। তাদের যুক্তি, স্টেশনটি উত্তরে সরিয়ে নিলেও পূর্ব নকশা অনুযায়ী নতুন করে সেই সৌকর্যে তা গড়ে তোলা যাবে। সে ক্ষেত্রে ভাঙায় অসুবিধা কোথায়?
কিন্তু মূলত ঐতিহ্য ও নান্দনিক প্রেরণায় নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের আহ্বান, দেশের স্থাপত্য ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রেলস্টেশনটি না ভেঙে উন্নয়নের যাত্রায় বিকল্প চিন্তা করা উচিত। এই স্টেশনটির স্থপতি দুই মার্কিন শিল্পী ড্যানিয়েল বার্নহ্যাম এবং বব লুই নাকি সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউস এবং গ্রামবাংলার কুঁড়েঘরের মিশ্ররূপে কমলাপুর স্টেশনের নকশা তৈরি করেন। শুধু ছাদ আর চারদিক খোলামেলা রাখার আটপৌরে পরিবেশের বৈশিষ্ট্যে এই নকশায় গ্রামবাংলার প্রাণের অনন্য নান্দনিক প্রকাশ তুলে ধরা হয়েছিল।
জনৈক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, যে বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনার উন্নয়নের চিন্তা মাথায় রাখলে এই সমস্যার সৃষ্টি হতো না। বরং স্টেশন ভবনকে যথাস্থানে রক্ষা করে উন্নয়নের পথ খোঁজাই ঐতিহ্য রক্ষার বাস্তব উপায়। এদের বক্তব্যে নান্দনিক সৌন্দর্যের ও ঐতিহ্যের চিন্তার আবেগই প্রাধান্য পেয়েছে। আমরা জানি না, এসব বিশেষজ্ঞ মতামতের গুরুত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রাহ্য হবে কি না। না হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক।
তিন.
এ দেশে ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত মতামতের অহমবোধই সাধারণত প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাই হয়তো সত্যে পরিণত হতে পারে—আর সে পরিস্থিতির পরিণামে ভাঙা পড়ে যেতে পারে বিদেশি স্থপতিদের স্বপ্নের নকশা। আর সে আশঙ্কা থেকে এমন সংবাদ শিরোনাম তৈরি হচ্ছে : ‘কমলাপুর রেলস্টেশনের ভবিষ্যৎ কী?’ যত দূর তথ্য-উপাত্ত ও মতামতের সম্মুখীন হওয়া যাচ্ছে, তাতে অঘটনের সম্ভাবনাই অধিক বলে মনে হয়। স্থাপত্য ভাস্কর্যবিষয়ক আমাদের পূর্ব ইতিহাস তেমনি সম্ভাবনার পক্ষেই রায় দেয়। তবু প্রত্যাশা, দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্তে পৌঁছান সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এবং কী পরিণাম জোটে কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাগ্যে।
তবে এটা ঠিক, কমলাপুর স্টেশন ভাঙা নিয়ে, এর ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়টি এখনো যথেষ্ট পরিষ্কার নয়, অদূর ভবিষ্যৎই তা বলতে পারবে। কিন্তু ভিন্নমত ও বিতর্ক এরই মধ্যে তাতে জড়িয়ে রয়েছে। তাই সমাজসচেতন নাগরিকদের মনে যত আশঙ্কা এর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
এখন শুধু অপেক্ষা ঘণ্টা বাজার, শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার। ঢাকার সাংস্কৃতিক এলিট শ্রেণি এটি ভাঙার বিপক্ষে। অন্যদিকে রেল কর্তৃপক্ষ ভাঙার পক্ষে, আবার কখনো কেউ হঠাৎ ভিন্ন মন্তব্যও করছেন। গোটা বিষয়টি রহস্যের কুয়াশা ঘেরা অবস্থায়। তবে শিগগিরই অবস্থার ‘মুশকিল আহসান’ ঘটবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা—সুদর্শন কমলাপুরকে পাব কী পাব না, চিরতরে হারিয়ে যাবে কি না।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী