মোবাইল ইন্টারনেটের গতির দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু বাংলাদেশের চেয়ে কম গতির ইন্টারনেট রয়েছে আফগানিস্তানে। এমনকি আফ্রিকার দরিদ্র দেশ বলে পরিচিত ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার চাইতেও খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের। অনলাইনে ইন্টারনেটের গতি দেখা যায়, এমন একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট স্পিডটেস্ট-এর গ্লোবাল ইনডেক্সের গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশ করা সূচকে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
অথচ বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরগুলো অনেকদিন ধরেই ফোরজি গতির ইন্টারনেট সেবা দিয়ে আসছে বলে দাবি করে। এমনকি খুব শিগগিরই তারা ইন্টারনেটের নবতম প্রযুক্তি ফাইভজি সেবা দেবে এমন কথাবার্তাও শোনা গেছে।
আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও বড় একটি মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তাদের ইন্টারনেটের গতি কম থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
তবে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলছেন, মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে পরিমাণে ইন্টারনেট গ্রাহক রয়েছে তার চাইতে স্পেকট্রাম বা তরঙ্গের পরিমাণ কম থাকায় ইন্টারনেটের গতি কম হচ্ছে।
এরকম পরিস্থিতিতে আগামী সোমবার (৮ মার্চ) নতুন স্পেকট্রাম বরাদ্দের জন্য নিলাম আয়োজন করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এই নিলাম থেকে অপারেটররা প্রয়োজনীয় স্পেকট্রাম কিনে নেয়ার পর আগামী মাস থেকে ইন্টারনেট সেবার অগ্রগতি হবে বলে তারা আশা করছেন।
বাংলাদেশের গ্রাহক অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশের যেসব মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের একটি বড় অংশই যোগাযোগ, ব্রাউজিং বা বিনোদনের ক্ষেত্রে মোবাইল ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই মোবাইল ইন্টারনেটের গতি নিয়ে মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাইমুনা সুলতানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয়। তার নিজের একটি ফেসবুক পাতা ও ইউটিউব চ্যানেল আছে, যেখানে তিনি লাইভ স্ট্রিম করেন, ছবি/ভিডিও আপলোড করেন।
কিন্তু সম্প্রতি প্রয়োজনীয় গতির ইন্টারনেট সেবা না পেয়ে মোবাইলের অপারেটর বদলেছেন। কিন্তু তেমন কোনো লাভ হয়নি তার। দুটি অপারেটর তাদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও প্রচারণায় দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগের দাবি করলেও মাঝে মাঝে ঢাকার ভেতরেই সংযোগ পেতে ঝামেলায় পেন মিস সুলতানা।
বিশেষ করে কোন ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা ১২তলার ওপরে গেলে তিনি তার অপারেটর থেকে আর নেটওয়ার্ক পান না।
আবার ঢাকার বাইরে অনেক জেলাতেও একই জটিলতার মুখে পড়তে হয় তাকে। এভাবে যখন তখন সংযোগ চলে যাওয়া বা ইন্টারনেট স্পিড কমে যাওয়ার কারণে তিনি যে প্যাকেজগুলো কেনেন তার বেশিরভাগই অপচয় হয়ে যায়।
মিস সুলতানা বলেন, আমরা গত মাসে শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। জায়গাটা এমন দুর্গম কোথাও না, শহরের কাছেই। কিন্তু আমার দুটা অপারেটরের একটাতেও ইন্টারনেট কানেক্ট করতে পারিনি। অথচ দুটাতেই আমি সাত দিনের প্যাকেজ কিনে রেখেছিলাম। আমার পুরো টাকাটাই অপচয় হলো।
তিনি বলেন, আমার অফিস ঢাকাতেই একটা বহুতল ভবনের ১২ তলার ওপরে। সেখানেও নেটওয়ার্ক পেতে এতো ঝামেলা হয়! ওয়াইফাই থাকায় কাজ চালিয়ে নিতে পারি।
মোবাইল অপারেটরগুলো ফোরজি ইন্টারনেট দেয়ার দাবি করলেও সেটার সাথে পারফরমেন্সের কোনো মিল নেই বলে অভিযোগ করেছেন সাদিয়া হক।
তিনি অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন, সেক্ষেত্রে দিন রাত তাকে ইন্টারনেট সংযোগের ওপর নির্ভর করতে হয়।
মিসেস হক অভিযোগের স্বরে বলেন, ওরা দাবি করে ফোরজি স্পিড, কিন্তু আমি লাইভ করতে গেলে কিছুক্ষণ পরেই ফুটেজ এতো খারাপ আসে। ফোরজিতে তো এমন হওয়ার কথা না। মাঝে মাঝে ইউটিউবেতে বাফারিং হয়। অথচ টাকা তো কম নিচ্ছে না। অন্য দেশের চাইতে বেশিই নিচ্ছে।
স্পিডটেস্ট-এর সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান
প্রতিষ্ঠানটি মোট ১৪০টি দেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি জরিপ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। যা গত বছরের চাইতে এক ধাপ পিছিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মালদ্বীপ। দেশটির অবস্থান ৪৫তম।
এরপরেই ৮৮তম অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমার। নেপালের অবস্থান ১১৪তম। এর চার ধাপ পিছিয়ে ১১৮তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। ১২০তম অবস্থানে শ্রীলঙ্কা। ভারত ১৩১তম অবস্থানে। এবং সবচেয়ে নিচে ১৪০তম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান।
মোবাইলের ইন্টারনেটের গতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ১৮৩ এমবিপিএস এর বেশি। তার পরেই রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, কাতার, চীন, সৌদি আরব, নরওয়ে, কুয়েত ও অস্ট্রেলিয়া।
এই প্রতিটি দেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ১০০-১৭০ এমবিপিএস এর বেশি। সে হিসেবে ১৩৬তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ১০.৫৭ এমবিপিএস। যেটা কি না ভারতে ১২.৪১ এমবিপিএস এবং পাকিস্তানে প্রায় ১৮ এমবিপিএস।
অবশ্য ওই একই সূচকে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে অন্য অনেক দেশের চাইতেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। সেখানে ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬। যা গত বছরের চাইতে এক ধাপ এগিয়ে এসেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ডাউনলোড গতি গড়ে ৩৩.৫৪ এমবিপিএস বলে ওই সূচকে উঠে এসেছে। সে হিসেবে তুরস্ক, গ্রিসের চাইতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
এমনকি মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ার চাইতেও বাংলাদেশ এই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গতিতে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে।
বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের স্পিড বেশি থাকার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে এই ইন্টারনেট মানুষ কেবলের মাধ্যমে ব্যবহার করে। যেখানে কি না মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্পেকট্রাম বা বেতার তরঙ্গ।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের এই কেবল দেশের প্রতিটি পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার কারণে নেটওয়ার্ক পেতে কোনো সমস্যা হয় না।
মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বাড়াতে কী করা হচ্ছে
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলছেন, বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর যে পরিমাণ গ্রাহক রয়েছে, সে হিসেবে তাদের স্পেকট্রাম বা বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের পরিমাণ কম।
তিনি বলেন, ধরুন একটি অপারেটরের গ্রাহকের সংখ্যা আট কোটি। কিন্তু তাদের স্পেকট্রাম বরাদ্দ আছে মাত্র ৩৭ মেগাহার্টজ। যেখানে গ্রাহক হিসেবে তাদের থাকার কথা ছিল ১০০ মেগাহার্টজের মতো। এই বেতার তরঙ্গই হল মোবাইল নেটওয়ার্কের মেরুদণ্ড। এটি ঠিক না থাকলে, কোনোটাই ঠিক থাকবে না।
গত এক বছর বাংলাদেশে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার দুই গুণ বেড়েছে। কিন্তু এর সাথে মানিয়ে নিতে টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা অর্থাৎ তাদের বেতার তরঙ্গের ব্যবহার সে অনুপাতে বাড়েনি।
এ কারণে গ্রাহকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ইন্টারনেটের গতি পাচ্ছে না বলে জানান মন্ত্রী জব্বার। তিনি বলেন, আমরা টুজি থেকে থ্রিজিতে আসতে ২৪ বছর সময় নিয়েছি। ২০১৩ সালে থ্রিজি আসার ৫ বছরের মাথায় ২০১৮ সালে আমরা ফোরজিতে আসি। ২০১৯ সালে অপারেটরগুলো প্রস্তুতিমূলক কিছু কাজ করেছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের কারণে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ সেভাবে এগোয়নি।
এখন এই মোবাইল ইন্টারনেটের এই গতি বাড়ানো লক্ষ্যে ৮ মার্চ বেতার তরঙ্গ নিলাম করতে যাচ্ছে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।
বিভিন্ন ব্যান্ডে অব্যবহৃত যে বেতার তরঙ্গ যা আছে তার পুরোটাই নিলামে তোলা হবে বলে জানা গেছে।
মোবাইল অপারেটররা তাদের গ্রাহকের সংখ্যা হিসেবে যদি এই নিলাম থেকে বেতার তরঙ্গ কেনার সুযোগ গ্রহণ করেন। তাহলে মার্চের পর থেকেই ইন্টারনেটের গতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে তিনি আশা করছেন।
মোবাইল অপরেটর প্রতিষ্ঠানগুলো এই বেতার তরঙ্গ কেনার ব্যাপারে আবেদন করেছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া যেখানে ফাইবার অপটিকস আছে, সেখান থেকে তারা কেবল টেনে নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারতো।
বিশেষ করে বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে বেতার তরঙ্গে সমস্যা হয় সেখানে বড় ব্যান্ডউইথ নিতে ফাইবার অপটিকস কাজে আসতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটর কিংবা নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক-এনটিটিএন সেই কাজটিও করতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন মোস্তফা জব্বার।
তবে ২৬ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের ৮০% গ্রাহককে ফোরজি ইন্টারনেট সেবার মধ্যে আনতে টেলিকমগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
এরইমধ্যে দেশের প্রধান দুটি প্রধান মোবাইল অপারেটর কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলেই তিনি জানান।
বাড়তি বেতার তরঙ্গ যোগ হলে গ্রাহক সেবার মানও আগের চাইতে ভালো হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে ফোরজি হ্যান্ডসেট না থাকাও এই ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আরেকটি কারণ বলে জানিয়েছেন মোস্তফা জব্বার।
মানসম্মত সেবার দাবি এমটবের
বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন এমটব-এর মহাসচিব এস এম ফরহাদ দাবি করেছেন যে অনেক সমস্যার মধ্যেও মোবাইল অপারেটরগুলো মানসম্মত সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তার মতে, করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালীন মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাওয়ায় সেবার মানে প্রভাব পড়েছে। তবে প্রায় ১০.৫০ এমবিপিএস গতি ফোরজি সেবার জন্য ভাল গতি হিসাবে মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, অপারেটররা স্পেকট্রামের ঘাটতি, লাইসেন্স বিভাজন ইত্যাদিসহ বেশ কিছু অমীমাংসিত সমস্যার মধ্যেও মানসম্মত সেবা দিয়ে চলেছে।
মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর আরেকটি উপায় হল মোবাইল টাওয়ারের সংখ্যা বাড়ানো।
গত প্রায় আড়াই বছরের বেশি সময়ে মোবাইল টাওয়ার বসানো যায়নি। কিন্তু এ সময়ে গ্রাহকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
গ্রাহক বাড়া সত্ত্বেও নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে পড়ায় ইন্টারনেটের গতিতে প্রভাব পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে ।
তবে ফরহাদ জানিয়েছেন যে, সম্প্রতি টাওয়ার কোম্পানিগুলো কাজ শুরু করেছে। তাছাড়া ৮ মার্চের নিলামে নতুন করে স্পেকট্রাম বরাদ্দ হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে তিনি আশা করছেন। তিনি বলেন, ‘আসলে সঠিক নীতি, নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ পরিস্থিতি উন্নত করতে পারে।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা