মিয়ানমারে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জান্তা সরকারকে আর্থিকভাবে অচল ও পঙ্গু করার লক্ষ্যে এবার প্রথম কর্মসূচির ঘোষণা দিল দেশটির নবগঠিত ছায়া সরকার।
মঙ্গলবার সু চির দল এনএলডি ও সেনাবিরোধী অন্য দলগুলোর নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত এ সরকার ‘দ্য কমিটি রিপ্রেজেনটিং পিদংসু হ্লুত্তাও’ (সিআরপিএইচ) প্রথম পদক্ষেপেই কর আদায় বন্ধের ডাক দিলেন মিয়ানমারে।
বৃহস্পতিবার ছায়া সরকারের এক বিবৃতিতে কর আদায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের এই আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, শুল্ক বিভাগের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর আদায় ও এ সম্পর্কিত সব কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
কাজ বন্ধ করে সব সরকারি কর্মচারীকে নাগরিক অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই সরকারের পক্ষ থেকে। আন্দোলনে যোগ দিতে ডেডলাইনও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ৭ মার্চ মধ্যরাতের আগে আন্দোলনে যোগ দেওয়া আর না দেওয়া সব কর্মচারীর তালিকা তৈরি করা হবে।
যারা যোগ দেবে না, তাদের গণশত্রু হিসাবে অভিহিত করা হবে। ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নভেম্বরের নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে দেশের ক্ষমতার দখল নেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী, তাতমাদো।
এদিনই প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিসহ নির্বাচিত বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধিকেই আটক করা হয়। এক বছরের জন্য জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা গণহত্যায় অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা ও বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে গঠন করা হয় মিলিটারি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল।
১১ সদস্যের এই কাউন্সিলই বর্তমানে মিয়ানমারের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সেনার এই অবৈধ ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে শুরু হয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, যা গত এক মাসে সর্বাত্মক রূপ নিয়েছে।
জান্তা সরকারের ক্ষমতার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে গত সপ্তাহেই (মঙ্গলবার) সমমনা আরও কয়েকটি দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে একটি ছায়া সরকার গঠন করে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। নতুন এই সরকারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কমিটি রিপ্রেজেনটিং পিদংসু হ্ল–ত্তাও’ বা সিআরপিএইচ।
ভারপ্রাপ্ত চার মন্ত্রীর নামও ঘোষণা করা হয়েছে। চার মন্ত্রী ও সিআরপিএইচ কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এই ছায়া সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কাজও শুরু করেছে। বুধবারই সেনা কর্তৃপক্ষ ‘মিলিটারি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল’কে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এর পরই সেনা সরকার অচল করার লক্ষ্যে প্রথম কর্মসূচি ঘোষণা করে। বৃহস্পতিবার সিআরপিএইচ নিযুক্ত মন্ত্রী ইউ লুইন কো ল্যাট স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে।’
এর আগে বুধবার ইউনিয়ন সংসদ হিসাবে দায়িত্ব পালন করা সিআরপিএইচ ২০২০ সালের ইউনিয়ন কর আইনে সংশোধনী আনে। এতে কর আদায় স্থগিতের কথা বলা হয়েছে। আইনটি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য আগস্ট মাসে সংসদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। মূলত এই আইনের ওপর ভিত্তি করেই সিআরপিএইচ এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর আদায় বন্ধের আহ্বান জানায়।
বুধবার সিআরপিএইচ-এর একজন প্রতিনিধি বলেন, ‘জনগণের করের টাকা দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদকারীদের হত্যার জন্য তহবিল বানাবে, এটা হতে দেওয়া যায় না।
এ কারণেই আমরা কর আদায় বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি।’ যদিও ২০২০ সালের কর সংশোধনী আইনের যৌক্তিকতার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার জন্য আইনটি করা হয়েছিল।
অভ্যুত্থানের পর থেকেই সেনাবাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করে রাস্তায় নেমেছে লাখ লাখ মিয়ানমার নাগরিক। এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়েছে সেনার অনুগত পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। এখন পর্যন্ত ৬০ জনেরও বেশি নাগরিককে হত্যা করেছে তারা। করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে আয়কর ও সব বাণিজ্যিক কর আদায় স্থগিত রেখেছিল এনএলডি সরকার।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিআরপিএইচ মন্ত্রী বলেছেন, ‘কোনো বেসামরিক কর্মচারী যদি সংশোধনী আদেশ বহাল রাখতে এবং কর আদায় করতে ব্যর্থ হন, তাহলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ছায়া সরকারের করবিষয়ক এ আহ্বানকে সমর্থন জানিয়েছে জনতাও। নির্বাচিত নেতারা মুক্ত হওয়া পর্যন্ত কর দেয়া বন্ধ রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। যদিও তাদের অভিযোগ, কিছু সরকারি কর্মচারী এখনো সামরিক শাসনের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এসব কর্মচারীকে কাজ বন্ধ করে আগামীকালের মধ্যে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সিআরপিএইচের এক মন্ত্রী।
শুক্রবার ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া, শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রী ড. জাও ওয়েই সু বলেন, ‘৭ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত কারা কারা চলমান জান্তাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন না, অথচ অবৈধ সরকারের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন-আমরা তার একটি তালিকা করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের এই আন্দোলনে অংশ না নেওয়ার অর্থ জনস্বার্থকে উপেক্ষা করা।’
সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া ওই স্ট্যাটাসে তিনি আরও জানান, ‘এটাই চূড়ান্ত অনুরোধ। একটা সময় দেখবেন আন্দোলনে ঢোকার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় এবং ভালো-মন্দকে তখনই আলাদা করা হবে। আপনি জনগণের নাকি স্বৈরশাসকের পক্ষে দাঁড়াবেন-সে সিদ্ধান্ত জানানোর সময় এখনই।’
জান্তার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক বিদ্রোহ বাড়ছে
মিয়ানমারে সেনা কর্তৃপক্ষের ক্রমবর্ধমান রক্তক্ষয়ী দমনপীড়নের পর একে একে বিদ্রোহ জানাচ্ছে দেশটির কূটনীতিকরা।
জাতিসংঘে নতুন রাষ্ট্রদূতসহ এখন পর্যন্ত অন্তত এক ডজন কূটনীতিক সেনা কর্তৃপক্ষের পক্ষে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারা প্রায় সবাই অভিন্ন সুরে বলছেন-আমরা আর সামরিক শাসনের পক্ষে কাজ করব না।