‘দলের ভিতরে থাকা বিশ্বাসঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ তৈরি করেছিল’

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

মোকতাদির চৌধুরী

দলের ভিতরে থাকা বিশ্বাসঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ তৈরি করেছিল বলে মন্তব্য করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধু অনেক উদার ছিলেন, সেজন্য তিনি খন্দকার মোশতাকের সব ভুল ক্ষমা করে দিয়ে তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন কিন্তু মোশতাকরা সবসময় তাকে পিছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করেছে এবং যার সফল বাস্তবায়ন ঘটায় তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।

তিনি বলেন, ৭ মার্চ বাঙালি জাতির জন্য এক অন্যন্য সাধারণ দিন। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এটি একটি বড় মাইলফলক। কিন্তু ৭ মার্চ হঠাৎ করে আসেনি। এর পশ্চাৎ কাহিনি অনেক আছে। রাজপথের কর্মী হিসেবে দেখেছি,১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে বের করে আনা,৭০ এর নির্বাচন, একাত্তরের প্রথমদিকের দিনগুলো। সেসময় একই ধরনের স্লোগানে সারা বাংলাদেশ মুখরিত হয়েছিল -তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। এই মার্চের আগেও স্লোগান ছিল, সেটি হলো- দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা। রাস্তায় রাস্তায় গাওয়া হতো অগণিত তাৎপর্যপূর্ণ গান ও কবিতা।

universel cardiac hospital

রোববার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ দিবস উপলক্ষে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে যখন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দিয়েছিলেন তখন আইয়ুব খান বলেছিলেন আমরা শেখ মুজিবকে অস্ত্রের মাধ্যমে মোকাবেলা করব। যুদ্ধ ছাড়া ছয়দফা বাস্তবায়ন হতে দেব না। এসবের ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭০ সাল। আপনারা জানেন, ঐ বছর নভেম্বরে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল এবং সেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল। সেই ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করে এসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন প্রয়োজনবোধে এই বাংলার আরও দশ লক্ষ মানুষ জীবন দিবে তবু বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ব।

প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্তভাবে সমগ্র বাঙালির দুঃখ, কষ্ট ও বঞ্চনার কথা অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন। সেদিন তিনি তদানিন্তন প্রেজেন্ট সিচুয়েশন নিয়ে কথা বলেছিলেন। সামরিক জান্তা কীভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে এসব তুলে ধরেছিলেন। তারপরই তিনি বাঙালির হৃদয়ের কথাটি ঘোষণা করেছিলেন; ‘ আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। তাঁর প্রতিটি কথাই ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ৭ মার্চের ভাষণের ধারাবাহিকতায় চলমান অসহযোগ আনদোলনের প্রেক্ষাপটে আসে ২৬ মার্চ। সেসময় বঙ্গবন্ধু বেতারের মাধ্যমে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার বার্তা। তিনি বলেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর সেদিন মুষ্টিমেয় বাংলা ভাষাভাষী নরাধম ছাড়া এদেশের প্রতিটি মানুষই স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। যারা বিরুদ্ধে ছিল, তাদের ভিতরে কোনো অনুভূতি ছিল না, মানুষের প্রতি, এমনকি নিজের ও নিজের ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান কারও প্রতি ভালোবাসা ছিল না।

তিনি বলেন, ৭ মার্চ আমরা আগে পালন করেছি দলীয়ভাবে। কিন্তু এই দিবসটি যে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা আবশ্যক এই কথাটি আমাদের উপলব্ধিতে এসেছে অনেক পরে এবং সেখানে ইউনেস্কো আমাদেরকে এই পথটা দেখিয়েছে। আর সেজন্যই সরকার এটাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি মনে করি, এটি যথার্থ সিদ্ধান্ত। বঙ্গবন্ধু মুজিবের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এটি আরও বেশি যথার্থতা লাভ করেছে।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে অনেক উদাসীন ছিলেন। আর সেজন্যই তিনি বেশি দিন রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্র ও দলের ভিতরে থাকা বিশ্বাসঘাতকেরা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছিল। সেইদিন আবার আসুক আমরা সেটি চাই না। সেইসময়ের আমিও একজন ভুক্তভোগী। পচাত্তরের পরে আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমাকে কারাগারের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কারাগারকে আমি ভয় পাই না। কিন্তু ভয় পাই অন্য জায়গায়। কারণ বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসন যদি আরও প্রলম্বিত হতো তাহলে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে আরও বহুদূর এগিয়ে যেতাম। কেননা মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু যেখানে দেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন, সেখান থেকে উন্নয়নশীল দেশে আসতে আমাদের ৪৫ বছর লেগেছে।

তিনি বলেন, আজকে আমরা শেখ হাসিনার বহু অবদানের কথা বিবেচনা করি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশের উন্নয়নে কী অবদান রেখেছিলেন তা কি আমরা জানি? আমাদের কোনো আর্থিক ব্যবস্থাপনা ছিল না, সেন্ট্রাল ব্যাংকিং সিস্টেম ছিল না, পুলিশ বাহিনী ছিল না, এডমিনিস্ট্রেশন সিস্টেম ছিল না, বিমান বাহিনী ছিল না, নৌবাহিনী ছিল না, যে সেনাবাহিনী তাকে সপরিবারে হত্যা করেছিল সেই সেনাবাহিনীও ছিল না, সেগুলো তিনি করেছেন। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রকে দ্বার করাতে যা যা প্রয়োজন সবকিছু তিনি করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুল, কালভার্ট, ব্রীজ তিনি নির্মাণ করেছিলেন। আমাদের এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু এই এক কোটি মানুষসহ যুদ্ধে বাস্তুহারা প্রায় ৩ কোটি মানুষকে তিনি পুনর্বাসন করেছিলেন।

জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, পৌরসভার মেয়র মিসেস নায়ার কবির ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার।

শেয়ার করুন