দারিদ্র্য নির্মূলে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে পারেন বাইডেন: ক্রিস্টফ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ক্রিস্টিফার

শিশু-দারিদ্র্য যুক্তরাষ্ট্রের বড় কলঙ্কগুলোর একটি। ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী এবং শক্তিশালী দেশটিতে শিশু-দারিদ্র্যের হার বিস্ময়কর। যুক্তরাষ্ট্র এই কলঙ্ক মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু করেছে। গত বুধবার শিশু-দারিদ্র্য নিরসনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ১ লাখ ৯০ হাজার ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে।

এই প্রণোদনা প্যাকেজের পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে দ্রুত শিশু-দারিদ্র্যের হার কমে আসবে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানিয়েছেন, এই পদক্ষেপগুলো স্থায়ী হলে শিশু-দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নেমে আসবে। বাইডেনের এই বৈপ্লবিক উদ্যোগ সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের প্রবীণ নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষায় নেওয়া উদ্যোগের সঙ্গে তুলনীয়। সব সমাজেই দরিদ্র শিশুদের কল্যাণে বিনিয়োগের নজির রয়েছে। এই বিনিয়োগ কী ফল বয়ে আনে তা দেখতে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর দিকে তাকানো যাক।

৫০ বছর আগে এই মাসেই গণহত্যা, দারিদ্র্য আর অনাহারের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। হেনরি কিসিঞ্জার তখন দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ ছবিগুলো বিশ্বে বাংলাদেশের একটি হতাশাজনক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৯১ সালের এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। আমি তখন নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলাম, ‘বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্ভাগা দেশ’। তখনকার প্রেক্ষাপটে আমি ঠিকই লিখেছিলাম। এধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়াও বাংলাদেশকে তখন অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। কিন্তু গত তিন দশকে আমার সব অনুমান ভুল প্রমাণিত করে বাংলাদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমান মহামারির আগে চার বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতি বছর সাত থেকে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা চীনের চেয়েও দ্রুততর। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। এটা যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপির ১০টি কাউন্টিসহ আরও কিছু জায়গার চেয়ে বেশি। একসময় হতাশার প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠা বাংলাদেশ এখন অনেক দেশেরই উন্নয়নের মডেল হতে পারে।

বাংলাদেশের এই উন্নয়নে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষা ও নারীর উন্নতি। আশির দশকে বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশেরও কম শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারত। বিশেষত, মেয়েরা খুবই কম শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিক অবদানের ক্ষেত্রে উপেক্ষিত ছিল। কিন্তু দেশটির সরকার ও নাগরিক সংস্থাগুলো ধারাবাহিকভাবে নারীশিক্ষায় উৎসাহিত করেছে। এখন বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে। আগে নারী-পুরুষের বৈষম্য থাকলেও এখন বাংলাদেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।

ক্ষুদ্রঋণের উদ্ভাবক নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা হচ্ছে, নারীর অবস্থান পরিবর্তন, যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দরিদ্র নারীদের জীবনমানের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে। ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই ব্যাংক অনেক নারীকে উদ্যোক্তা বানিয়েছে। মোবাইল ফোন পরিষেবা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে গত চার বছরে প্রায় এক লাখ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এটা তাদের যেমন স্বাবলম্বী করেছে, তেমনি দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ নারীদের শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত করেছে। এই শিক্ষিত নারীরাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প নারীদের কর্মসংস্থানের বড় জায়গা হয়ে উঠেছে। যে শার্টটি আপনি এখন পরে আছেন, হতে পারে সেটা বাংলাদেশের কোনো নারীর বানানো। বাংলাদেশ এখন চীনের পরে বিশ্বের বৃহত্তম তৈরি পোশাক শিল্প রফতানিকারক দেশ।

এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে যৌন হেনস্তার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। ২০১৩ সালে একটি কারখানা ধসে ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিল। তবে শ্রমিকরাই বলছে, ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করে ভাত রান্নার কাজ করার চেয়ে এ ধরনের চাকরি অনেক ভালো। শ্রমিক ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজ শ্রমিকদের সুরক্ষায় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অনেক উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশের শিক্ষিত নারীরা এখন গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে কাজ করছে। এই নারীরাই শিশুদের টিকাদানে ভূমিকা রেখেছে। মানুষকে টয়লেট ব্যবহারে সচেতন করে তুলেছে। গ্রামের মানুষকে পড়তে শিখিয়েছে। তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি শিখিয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

কোনো মহান রাজনৈতিক নেতা না এলেও মানবসম্পদে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ সমাজে যে গতিধারা সৃষ্টি করেছে, তা সবার জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে ‘অনুপ্রেরণার আখ্যান’হিসেবে বর্ণনা করেছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্রমুক্ত হয়েছে। ১৯৯১ সালের পর অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে।

সংশয়ী পাঠকরা হয়তো মাথা নেড়ে বিড়বিড় করছেন যে, জনসংখ্যার অতিঘনত্ব হয়তো অচিরেই এই উন্নয়নের গতিরোধ করবে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের নারীরা এখন গড়ে দুটি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন।

মোটকথা, বাংলাদেশ বিনিয়োগ করেছে তার সবচেয়ে অবহেলিত সম্পদে, সবচেয়ে প্রান্তিক এবং কম উৎপাদনশীল অংশকে কেন্দ্র করে। এ কারণে বাংলাদেশের মুনাফাও হয়েছে সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রও এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সাতটি শিশুর মধ্যে একটি শিশু উচ্চ বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারে না। এমন একটি শিশুকে সহায়তা করতে পারলেও আমরা অনেক উপকৃত হবো।

শিশু-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কার্যক্রম সম্ভবত এটা করতে সক্ষম। আর ফেরতযোগ্য শিশু-কর-ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করা উচিত। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা দেখে আমরা বুঝতে পারি, প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করা নিছক তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের ব্যাপার নয়, দেশ ও জাতির উন্নতির জন্যই এটা দরকার।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

শেয়ার করুন