মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর রোববার ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন। এদিন গুলিতে ৩৯ জন মারা যান। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন দেড় শতাধিক। আহতদের মধ্যে আজ সোমবার মারা গেছেন ৩২ জন। এ নিয়ে রোববারের সহিংসতায় মোট মারা গেলেন ৭১ জন।
মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ দূত ক্রিস্টিন স্করেনার বার্জানার রক্তক্ষয়ী এ হতাকা-ের কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন।
এদিকে অভ্যুত্থানবিরোধরীরা আরও বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছেন জানতে পেরে জান্তা মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের কয়েকটি এলাকায় অংশবিশেষে ‘মার্শাল ল’ জারি করেছে। এছাড়া, সেনা সরকার সু চির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের শুনানি ১০ দিন পিছিয়েছে।
পাখির মতো মানুষ মারল মিয়ানমার জান্তা
রোববার শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত হ্লায়াইং থারইয়ায় চীনের বেশ কয়েকটি কারখানায় হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা। এ সময় তারা দুইটি কারখানায় অগ্নিসংযোগ করেন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। এ সময় ছুরি ও লাঠি হাতে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করেন বিক্ষোভকারীরা। সংঘর্ষ শুরু হলে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় নিরাপত্তাবাহিনী। এতে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়।
অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারসকে (এএপিপি) দেশটির এক প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক বলেন, এটা ভয়ঙ্কর। আমি চোখের সামনে গুলি করে বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে দেখেছি। এমন নৃশংস দৃশ্য জীবনেও ভুলতে পারব না।
তিনি আরও বলেন, চোখের সামনে গুলি করে পাখির মতো মানুষ মেরে ফেলছে জান্তা সরকার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, রোববার সারা দিন গুলির শব্দ শোনা যায় এবং রাস্তায় সামরিক ট্রাকের টহল ছিল। এক পুলিশ সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, পুলিশ ভারী অস্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। পরে পোস্ট মুছে ফেলে টিকটক পোস্টে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কোনো দয়া দেখাবো না।
অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানিয়েছে, রোববার নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৭০ বিক্ষোভকারী নিহত এবং ১২৯ জন হয়। এ নিয়ে দেশটিতে চলমান বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা ১৮০ জনে ছাড়িয়েছে। ডাক্তার এবং উদ্ধারকারীরা আরও নিহতের আশঙ্কা করছেন।
সু চির শুনানি বাতিল
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলের অং সান সু চির শুনানি বাতিল করেছে জান্তা সরকার। আজ সোমবার সু চির আইনজীবী আইনজীবী খিন মং ঝাও বলেন, এখানে কোনো ইন্টারনেট নেই। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানি হওয়ার কথা ছিল। আমরা ভিডিও কল করতে পারিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে ইন্টারনেট বন্ধ রাখছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ, সকালে নেটওয়ার্ক খুলে দেয়া হয়। কিন্তু সোমবার দিনের বেলায়ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক বন্ধ ছিল।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, মিয়ানমারজুড়ে মোবাইল ডেটা নেটওয়ার্ক কাজ না করায় সোমবার দেশটির ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চির শুনানি বাতিল করা হয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে আটক করে সেনাবাহিন। অং সান সু চিকে সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় রাজধানী নেপিডোতে ভিডিও শুনানিতে হাজির করার কথা ছিল।
মার্শাল ল’ জারি
রোববারের বিক্ষোভ-সহিংসতার জেরে ইয়াঙ্গুনের হ্লাইংথায়া ও সুয়েপিয়েথা এলাকায় মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। তবে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক প্রাণহানির পর সোমবার আবারও রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে জনতা। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থীরা জানিয়েছেন, জান্তার বুলেটের মুখে তারা থামবেন না।
সহিংসতার নিন্দা জাতিসংঘের দূতের
মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ দূত ক্রিস্টিন স্করেনার বার্জানার দেশটিতে অব্যাহত রক্তক্ষয়ী সহিংসতার কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন। রোববার রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের জনগণ ও তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার প্রতি সংহতি জানাতে, আঞ্চলিক দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।’
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের সংযত হওয়ার আহ্বান উপেক্ষা করে চলছে উল্লেখ করে বার্জানার বলেন, সামরিক বাহিনীর এই চলমান বর্বরতা- শান্তি ও স্থিতিশীলতার যে কোনো ধরনের সম্ভাবনার মারাত্মক ক্ষতি করছে। তাদের এ বর্বরতা থেকে হাসপাতালের কর্মীরাও বাদ যায়নি। তারা সরকারি অবকাঠামোরও ব্যাপক ক্ষতি করেছে।’
গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল বিজয় পায়। তবে দেশটির সেনাবাহিনী এ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনে। গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে অভ্যুত্থান করে সেনাবাহিনী। তারা সু চিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। একই সঙ্গে সু চিসহ দেশটির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে। এক বছরের জন্য মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাবাহিনী। সেনা অভ্যুত্থানের পরপরই মিয়ানমারে বিক্ষোভ শুরু হয়। হুমকি-ধমকি, দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার, গুলি সত্ত্বেও দেশটির গণতন্ত্রপন্থীরা সেনাশাসনের বিরুদ্ধে টানা বিক্ষোভ করে আসছেন।