জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ ধরে দেশকে উন্নত বিশ্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানান, গত ১২ ধরে ক্ষমতায় থাকাকালে জাতির পিতার দেখানো পথেই তিনি হাঁটছেন। এই প্রচেষ্টার ফলে আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। গত মাসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে বলে জানান সরকারপ্রধান।
সোমবার বিকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার ৬ষ্ঠ দিনের অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছিলেন প্রধান অতিথি।
বিশিষ্ট লেখিকা সেলিনা হোসেন অনুষ্ঠানে মূল বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী রাশিদা খানম এবং নেপালের প্রেসিডেন্টের কন্যা উষা কিরণ ভান্ডারি।
নেপালের রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তার উপস্থিতি এই অনুষ্ঠানের মর্যাদা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা নিজেরা সম্মানিত হয়েছি। গত বছর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তার উপস্থিত থাকার কথা ছিল। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে তিনি আসতে পারেননি। কিন্তু ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সে কথা স্মরণ করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নেপালের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগদান করায় আমি আমার নিজের এবং জনগণের পক্ষ থেকে তাকে এবং নেপালের জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, নেপাল আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন নেপাল সরকার এবং সেখানকার জনগণ নানাভাবে স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন।
তিনি বলেন, যেসব দেশ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে সর্বাগ্রে স্বীকৃতি দিয়েছিল, নেপাল তার অন্যতম। ১৯৭২ সালে জানুয়ারি মাসে নেপাল বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। আমরা নেপালের জনগণের সে অবদানের কথা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা ২০১২ এবং ২০১৩ সালে নেপালের ১১ জন নাগরিককে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ সম্মাননায় ভূষিত করি।
দুই দেশের চমৎকার সম্পর্কের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দুই দেশের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। আমাদের মধ্যে ভৌগোলিক নৈকট্য ছাড়াও আমাদের রয়েছে প্রায় একই ধরনের ইতিহাস। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের অবস্থান প্রায় এক এবং অভিন্ন।
বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, সড়ক, রেল এবং বিমান যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বিশেষ করে পানি-বিদ্যুৎ খাত, পর্যটন এবং পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সহযোগিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে বিবিআইএন চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। এরফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। নেপালকে আমরা আমাদের সৈয়দপুর আঞ্চলিক বিমানবন্দর এবং মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সব সময়ই শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। সকলের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের অগ্রগতি থেমে যায়।
তিনি বলেন, আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র নেপালও একইসঙ্গে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। আমি নেপালের সরকার এবং জনগণকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দক্ষিণ এশিয়ার এক বিশালসংখ্যক মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো অর্ধাহারে বা না খেয়ে প্রতিরাতে ঘুমাতে যায়। অনেকে জীবন ধারণের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সে সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করে এ অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এ অঞ্চলকে দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস আমরা অব্যাহত রাখব।
নেপালের রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমরা এমন একটি অঞ্চলে বাসবাস করি যা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দেশগুলো যেমন ভূমিকম্প, ক্লাউড ব্রাস্ট, বরফ ধ্বস, ভূমিধস, ফ্লাস ফ্লাড বা হরকা বান ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ, তেমনি বাংলাদেশের মতো সাগর-উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ বারবার বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি বা খরার মতো দুর্যোগের সম্মুখীন হয়।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের এ উপমহাদেশের দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি নাজুক করে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের অবদান না থাকলেও আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা অভিযোজনের মাধ্যমে সাময়িকভাবে নিজেদের রক্ষা করতে পারি, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা বন্ধ করা না গেলে অভিযোজন প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম বা সিভিএফ-এর বর্তমান সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব নেতৃত্বকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে আসছে। গত বছর ঢাকায় গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন, বাংলাদেশ অফিস চালু করা হয়েছে। ঢাকা অফিস দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কাজ শুরু করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এই শুভ মুহূর্তে আমি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববাসীকে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।