প্রায় ৮ বছর পরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইঙ্গিত দিয়েছে মিসর এবং তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুটি মুসলিম দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক এ অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং স্থায়ী শান্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মিসর কেন তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে? আর তুরস্কই বা কেন সামরিক স্বৈরশাসক আল-সিসির সঙ্গে হাত মিলাতে চাচ্ছে? এ ক্ষেত্রে দু’দেশ একে অপরেকে কি কি শর্ত দিচ্ছে?
সম্পর্ক খারাপ কেন?
মিসরের জনগণের ভোটে বৈধভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুরসিকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে তাকে কারাবন্দি করার পর থেকেই তুরস্ক মিসরের এই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার।
তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান তখন গণতন্ত্রের পক্ষে, জনগণের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। বজ্রকণ্ঠে সামরিক জান্তা সিসির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। মুরসির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে কথা বলেছিলেন। সেই থেকেই চলছে খারাপ সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ধীরে ধীরে একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছে। দুই দেশ তাদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেয়। দু’দেশের সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয়নি। শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই খারাপ হয়নি বরং আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়েই একে অপরের ঘোর বিরোধিতায় লিপ্ত। সিসি মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে। তুরস্ক তাদের জন্য দরজা খুলে দেয়।
মিসর কাতারের বিরুদ্ধে, তুরস্ক কাতারের পক্ষে। মিসর লিবিয়াতে খলিফা হাফতারের সন্ত্রাসী সংগঠনকে ক্ষমতায় বসানোর বাসনায় সহযোগিতা হাত বাড়ায়, তুরস্ক লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈধ সরকারকে রক্ষায় ত্রিপলির পাশে দাঁড়ায়। মিসর সিরিয়াতে বাশার আল আসাদের পক্ষ নেয়, তুরস্ক বিপক্ষে যায়। ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক-গ্রীস যখন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, মিসর তখন তুরস্ককে কোণঠাসা করতে গ্রীসের সঙ্গে আঁতাত করে।
কিন্তু গত কয়েক মাস ধরের দু দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছিল দুইও পক্ষ থেকে। আঙ্কারা এবং কায়রো থেকে কর্মকর্তারা গোপনে বৈঠক করেছেন অনেকবার। তুরস্কও বারবার আকারে ইঙ্গিতে জানিয়েছিল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা।
ভূমধ্যসাগরে সমস্যা
লিবিয়ার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে জলসীমা চুক্তি করে তুরস্ক। আর এই জলসীমা চুক্তির কারণে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে অর্থাৎ ইসরাইল, মিসর এমনকি সাইপ্রাস থেকে তুরস্কের ব্যতীত তেল ও গ্যাস রপ্তানির পথ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ভূমধ্যসাগরের নিচ দিয়ে কোনো পাইপলাইন নিতে হলে তুরস্কের জলসীমা দিয়ে নিতে হবে।
গ্রীস এবং ইসরাইল এ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকার শরণাপন্ন হয়। শুরু হয় এ অঞ্চলে তুরস্কবিরোধী তৎপরতা। তুরস্ককে কোণঠাসা করার জন্য যোগ দেয় মিসর, আরব আমিরাত, সৌদি আরব এমনকি ভারতও। কিন্তু ইসরাইল জানে যে, তুরস্ক ছাড়া তার তেল গ্যাস ইউরোপে পাঠানোর কোন উপায় নেই। তাই তুরস্কের বিরুদ্ধে নমনীয় থাকে ইসরাইল।
আর গ্রীস কয়েকমাস আগে মিসরের সঙ্গে একটি জলসীমা চুক্তি করে; যা তুরস্ক-লিবিয়া জলসীমাকে অস্বীকার করার শামিল। কিন্তু তুরস্ক-মিসরের ব্যাক ডোর ডিপ্লোম্যাসি বা গোপনীয় যোগাযোগের মাধ্যমে আঙ্কারা কায়রোকে এটা বুঝাতে সক্ষম হয় যে গ্রীসের সঙ্গে চুক্তি না করে যদি তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করে তাহলে ভূমধ্যসাগরে তার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিমাণ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বেড়ে যাবে। মিসর এতে গ্রিন সিগনাল দেয়।
সাম্প্রতিক মিসর ওই অঞ্চলে গ্যাস তেল অনুসন্ধানের যে টেন্ডার দেয় তাতে তুরস্কের ঘোষিত অঞ্চলকে মেনে নেয়। আর ওই অঞ্চলকে নিজের জলসীমার মধ্যে দেখায়নি। এতে আশাহত হয় গ্রীস। তড়িঘড়ি করে গ্রীক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিসর গিয়ে সাক্ষাৎ করে সিসি সরকারের সঙ্গে; কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। মিসর তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। ইতিমধ্যে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন মিসরের সঙ্গে তুরস্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যোগাযোগ করছে। কায়রো এবং আঙ্কারার মধ্যে শীঘ্রই চালু হবে কূটনৈতিক সম্পর্ক। এতে ক্ষিপ্ত হয় গ্রীস। গ্রীক মিডিয়া মিসরকে এক হাত দেখে নেয়। শুরু হয় মিসর বিরোধী প্রচারণা। মিসরকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে।
মিসর কেন তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়?
মিসরের সামরিক জান্তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক দেশ মিসরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। এবং স্বার্থ শেষ হলে সিসি সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। যেমন কাতারের ওপর থেকে সৌদি আরব এবং আমিরাতের নেতৃত্বে অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার সময় মিসরের কথায় কোন গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। এমনকি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মিসরকে জানানোও হয়নি। আরব-আমিরাত লিবিয়াতে মিসরকে তুরস্কের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। কিন্তু সেই আরব আমিরাতই এখন তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ভূমধ্যসাগরে ইসরাইল, গ্রীস, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুর্কি বিরোধী জোটে মিসরকেও আহ্বান করে। কায়রো তাতে সাড়াও দেয়। কিন্তু ইসরাইল তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে মরিয়া, গ্রীস তুরস্কের সঙ্গে ওপেন বৈঠক করেছে। ফ্রান্স তুরস্কের সঙ্গে নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের সঙ্গে বড় ধরণের ঝামেলায় জড়াবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রেও মিসরকে কেউ গুরুত্বই দেয়নি। অথচ মিসর তাদের সঙ্গে যোগ দিতে গিয়ে নিজের অনেক স্বার্থকেও জলাঞ্জলি দিয়েছিল। সুতরাং তুরস্কের সঙ্গে মিসরের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা তার নিজের স্বার্থেই দরকার।
সম্পর্ক ভালো হওয়ার ইঙ্গিত
কিন্তু যে তুরস্ক এক বাক্যে সিসিকে সামরিক জান্তা, স্বৈরশাসক, অবৈধ শাসক বলে অবজ্ঞা করে আসছিল এখন তার সঙ্গেই হাত মিলানোটা কেমন বেমানান না?
কিন্তু আবেগ এবং নীতি কথা অনেক সময় রাষ্ট্রস্বার্থের কাছে হার মেনে যায়। আর সে রাষ্ট্রের নেতা যদি হন এরদোগানের মত pragmatist বাস্তবাদি একজন প্রেসিডেন্ট। তবে সম্পর্ক কতটুকু স্বাভাবিক হবে। বা কতদ্রুত স্বাভাবিক হবে তা এখনই বলা মুশকিল। যদিয়ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন যে আলোচনা কোন পূর্বশর্ত ছাড়ই চলছে। কিন্তু আমরা জানি যে, আলোচনার টেবিলে আছে অনেকগুলো শর্ত।
অমিমাংসিত বিষয়গুলো
১. মিসরের সিসি সরকার: তুরস্ক এই সরকারকে কোনোভাবেই মেনে নেবে না। যতদিন এই সামরিক জান্তা ক্ষমতায় থাকবে ততদিন তুরস্কের সঙ্গে মিসরের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। কিন্তু যেহেতু সামরিক জান্তার খুব শীঘ্রই ক্ষমতা ছাড়ার সম্ভবনা নেই, সেহেতু মিসরের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করলে এই সামরিক জান্তার সঙ্গেই করতে হবে।
২. মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন: সিসি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে। অনেক মুসলিম দেশও মিসরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রায় শতবর্ষী এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তুরস্কের কাছ থেকেও একে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য জোর দেবে; কিন্তু তুরস্ক নিষিদ্ধ করবে না। হয়তো তাদের কিছু কার্যক্রমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে।
৩. লিবিয়াতে তুরস্কের সামরিক শক্তি কমিয়ে আনা: লিবিয়ায় পরস্পর বিরোধী অবস্থানে মিসর এবং তুরস্ক। তুরস্ক সমর্থিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লিবিয়া সরকার মিসর সমর্থিত হাফতারের সন্ত্রাসী গ্রুপকে যখন কোণঠাসা করেছিল তখন মিসর সরাসরি তার হাজার হাজার ট্যাঙ্ক এবং সৈন্য লিবিয়ায় পাঠিয়ে তুর্কি সমর্থিত বাহিনীকে ধুলিস্যাৎ করার হুমকি দেয়। লিবিয়ায় তখন তুরস্ক-মিসর একেবারের যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আসে। পরবর্তীতে দু’পক্ষ একটি যুদ্ধবিরোধী চুক্তিতে আসে যা এখনও বলবৎ আছে। এমনকি মিসর এখন লিবিয়ায় তুরস্ক সমর্থিত সরকারকে মেনে নিয়ে, ত্রিপলিতে তার দূতাবাস খোলার জন্য কাজ করছে।
৪. মিসরকে তুর্কি বিরোধী পদক্ষেপ থেকে সরে আসার জন্য চাপ দিচ্ছে তুরস্ক। যার একটি হল গ্রীসের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে জলসীমা চুক্তি। যদিও সে চুক্তি থেকে মিসর সরে আসেনি। কিন্তু চুক্তির আসল যে উদ্দেশ্য ছিল অর্থাৎ অঞ্চলে তুরস্কের দাবীকৃত জলসীমাকে মিসর নিজের জলসীমা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া। মিসর সে ঘোষণা না দিয়ে বরং তুরস্কের জলসীমার দাবিকে মেনে নিয়েছে।
৫. দু’দেশে নতুন করে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারে।
৬. দু দেশের মধ্যে ভূমধ্যসাগরে একটি জলসীমা চুক্তি হতে পারে।
৭. তুরস্ক মিসর-ইথিওপিয়া-সুদানেরর মধ্যে নীল নদের ওপর বাঁধ দেওয়া নিয়ে চলা বিবাদের মধ্যস্থতা করতে পারে।
৮. মিসরের সুয়েজ খালে আটকে পড়া বিশাল মালবাহী জাহাজকে অপসারণে তুরস্ক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু মনে হয় না মিসর এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে।
তবে এগুলোর কয়েকটা বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু খুব রাতারাতি হবে না। কারণ এগুলোর কোনটিই শুধু দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। আরও অনেক দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আছে এগুলোর সঙ্গে। ওইসব দেশ কী ধরণের চাল চালে তাও দেখার বিষয়। কিন্তু সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে সুবাতাস বইছে তা বাস্তবতায় রূপ পেলে উপকৃত হবে দু’ দেশের সাধারণ মানুষ। আর এ সুফল পাবে মধ্যপ্রাচ্যে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা।