দুধ কলা দিয়ে পোষা কাল সাপ

প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট ২০১৩ সাল। ১৩কে বলা হয় অশুভ। ২০১৩ সালটিও বাংলাদেশের জন্য অশুভ। অথচ বছরটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারতো।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার লঘুদণ্ডের প্রতিবাদে এবং সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে সৃষ্টি হয় অভাবিত এক গণজাগরণের। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সেই গণজাগরণের ঢেউ পৌঁছে যায় বাংলাদেশের কোনায় কোনায়। দাবিটা সরকারের কাছে হলেও সেই গণজাগরণ সরকারের প্রশ্রয় লাভ করে। আন্দোলনের মুখে সংসদে আইন সংশোধন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে রায়ের পর ‘ভি’চিহ্ন দেখানো কাদের মোল্লার ফাঁসি দিয়েই শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গ্লানিমুক্ত করার প্রক্রিয়া।

শাহবাগের সেই গণজাগরণের পর ভয় পেয়ে যায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, তাদের রাজনীতি বুঝি শেষ হয়ে গেল। আবার গণজারণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়ার সাহসও কারও ছিল না। তখন কৌশলে মাঠে নামানো হয় হেফাজতে ইসলাম নামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে। এই গোষ্ঠীটি কৌশলে গণজাগরণ মঞ্চকে ‘নাস্তিক ব্লগারর আন্দোলন বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। তাতে কিছুটা সফলও হয় তারা। অথচ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ছিল সত্যিকার অর্থেই গণমানুষের আন্দোলন। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে কোটি মানুষ সেখানে অংশ নিয়েছে। সেই মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন, হয়তো অবিশ্বাসী কেউ কেউ ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের সাথে আন্দোলনের মূল চেতনার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

গণজাগরণ মঞ্চের সাথে ইসলামেরও কোনো বিরোধ ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিটি হেফাজতে ইসলামকে সামনে রেখে শাহবাগের গণজাগরণকে ভিন্ন আঙ্গিকে চিত্রিত করার চেষ্টা করে। গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা হঠাৎ পাওয়া অভাবিত সাড়ায় তারাও নিজেদের সীমাটা বুঝতে পারেননি। তাই দাবি আদায় হওয়ার পর সাফল্যের মোহে শাহবাগে অবস্থান ধরে রেখে গণজাগরণকে তেতো করে ফেলে। এই সুযোগটাই নেয় হেফাজত। গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে ঢাকায় মতিঝিল শাপলা চত্বরে এপ্রিল ও মে মাসে দুই দফায় সমাবেশ করে। হেফাজতের আস্ফালনে সরকার গলজাগরণ মঞ্চের প্রতি তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন তুলে নেয় এবং শাহবাগ থেকে তাদের সরিয়ে দেয়।

গণজাগরণ মঞ্চকে যতটা সহজে রাজপথ থেকে সরানো গেছে, হেফাজতকে সরানো ততটা সহজ ছিল না। বিশেষ করে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে তাদের সমাবেশের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। গণজাগরণ মঞ্চ নয়, সেবার তাদের টার্গেট ছিল সরকার। দিনভর রাজধানীতে তাণ্ডব চালানোর পর তারা অবস্থান নেয় শাপলা চত্বরে। এবার তাদের দাবি সরকার পতনের। সরকারবিরোধী শক্তিগুলোও তাদের প্রতি সমর্থন জোগায়। সব মিলিয়ে হেফাজত এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, এমনকি তারা ছায়া সরকারও গঠন করে। তবে আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশলী অভিযানে তাদের সব স্বপ্ন শাপলা চত্বরে চাপা পড়ে যায়। সৈয়দ আশরাফ হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেও তাদের কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ বিচলিত করে আওয়ামী লীগের ভেতরের কাউকে কাউকে।

যে হেফাজত শাপলা চত্বরে এসেছিল সরকার পতন ঘটাতে, গোপন যোগাযোগ আর উপঢৌকনে সেই হেফাজতের সাথেই সখ্য গড়ে সরকারেরই একটি অংশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে নেতৃত্বশূন্য জামায়াতে ইসলামী; মামলা-হামলা আর দমন-পীড়নে কোণঠাসা বিএনপি। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে সরকার ছাড় দিতে থাকে। এ সুযোগে তারা একের পর এক অন্যায় আবদার পূরণ করে নেয়। হেফাজতের দাবি মেনে হাইকোর্ট চত্বর থেকে সরানো হয় গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য, পরিবর্তন আনে পাঠ্যপুস্তকে। তাদের বাড় এতটাই বাড়ে যে জন্ম শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার হুমকিও দেয় তারা।

সরকারের একটি অংশ দাবি করে, একসাথে সব মহলে শত্রু বাড়ানোর চেয়ে একটি অংশকে নিষ্ক্রিয় রাখতে পারলেই ভালো। তীব্র সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগের যুক্তি ছিল, তারা হেফাজত বা সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে কোনো আপস করছে না, এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু এই কৌশলের খেলা খেলতে গিয়ে আওয়ামী লীগ তার সহজাত সমর্থকদের দূরে ঠেলে যারা কখনোই তাদের ভোট দেবে না, সেই হেফাজতকে কাছে টানে। তখন অনেকেই বলেছিলেন, দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেও কোনো লাভ হয় না। সুযোগ পেলেই কাল সাপ ছোবল দেবে।

আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর এখন হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ উগ্রপন্থী জুনায়েদ বাবুনগরীর হাতে। তার সাথে আছে উগ্রতম সাম্প্রদায়িক মামুনুল হক। হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিপক্ষে নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে এই গোষ্ঠীটি। ভিন্ন মতাবলম্বী লেখক, সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ব্যাপারে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ করে। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম যেন সব আইনের ঊর্ধ্বে।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে হেফাজত নেতারা দিনের পর দিন ঘৃণা আর উগ্রতা ছড়িয়েছেন। কিন্তু সরকার তাদের দমন না করে আবারও সমঝোতার কৌশলে যায়। কিন্তু কুকুরের লেজ ঘি দিয়ে ডললেও সোজা হয় না। কুকুরের চাই মুগুর। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে আরও অনেকের মতো আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে কেন্দ্র আবারও মাঠে নামে উগ্র হেফাজতিরা। এক মাস ধরে তারা সারাদেশে ঘুরে ঘুরে ঘৃণা ছড়িয়েছে, সহিংসতার উসকানি দিয়েছে, জেহাদের ডাক দিয়েছে। জেহাদের ময়দানে মারা গেলেই শহীদ আর শহীদ হলেই অনন্ত বেহেশত- এ প্রলোভন সাধারণ মুসলমানকেও উগ্র বানিয়ে দেয়।

দিনের পর দিন প্রকাশ্যে এই জঙ্গিবাদের চর্চা হয়েছে। মামুনুল হকের এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সুনামগঞ্জের শাল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলায় বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে একটি গ্রাম। বারবার বলার পরও সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতদিন সব ধরনের ছাড় পেয়ে আসা এই গোষ্ঠীটি এখন বেপরোয়া। প্রচলিত আইন, সংবিধান, সরকার ব্যবস্থার প্রতি তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কিন্তু সরকার এতদিন তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। এতদিন দুধ কলা দিয়ে পোষা কাল সাপ এখন ছোবল দিচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা করেছে তারা সেটা কোনো আইনি রাষ্ট্রে মেনে নেয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। কারণ চট্টগ্রাম বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তো শুধু হেফাজতিরা থাকে না। আরও অনেক সাধারণ মানুষও সেখানে থাকে। তাতের নিরাপত্তা বিধানও সরকারের দায়িত্ব।

এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাশকতা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ কঠোর ব্যবস্থাটা আরও আগেই নেয়া উচিত ছিল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরও দেরি হওয়ার আগেই, সরকারের সম্পত্তি এবং সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষায় সরকারকে কঠোর হতে হবে। যারাই আইনের ব্যত্যয় ঘটাবে, তাদের বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজেদের কর্মকাণ্ডে হেফাজত প্রমাণ করেছে, সমঝোতা বা কৌশল কোনোটার যোগ্য তারা নয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ

শেয়ার করুন