ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতের হরতালের সময় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের জন্য পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। তারা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে।
আজ সোমবার দুপুর দুইটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান, স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার এই দাবি করেন।
সোমবার দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। মতবিনিময় সভায় সভাপতি ও স্থানীয় সাংসদ মোকতাদির চৌধুরী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বক্তব্য দেন।
মোকতাদির চৌধুরী এমপি তাঁর বক্তব্যে বলেন, গত শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেসব সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ও হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তার সব দায় দায়িত্ব হরতাল আহ্বানকারী হেফাজতে ইসলামকেই নিতে হবে।
তিনি বলেন, গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের দিন বিকেল ৩টার পর থেকেই হেফাজতিরা শহরে তাণ্ডব শুরু করে। তারা রেলস্টেশন ভাঙচুর করে কন্ট্রোল প্যানেল জ্বালিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সব ট্রেনের যাত্রা বিরতি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত রোববার বেলা ১১টার পর হেফাজতিরা বিনা উস্কানিকে শহরে তাণ্ডব লীলা চালায়। হামলার সময় সদর থানা থেকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, ‘বিক্ষোভকারী ভাইয়েরা আপনারা আমাদের ওপর ঢিল ছুঁড়বেন না, আমরা আপনাদের সাথে আছি’ মাইকে এই ঘোষণা শোনার পর হামলাকারীরা বিপুল উৎসাহে একের পর এক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর এই পর্যন্ত কোনও হরতালে রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে হামলা হয়নি। কিন্তু এবারই তারা পর্যায়ক্রমে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের বাড়ি, তার শ্বশুরবাড়ি, তার কার্যালয়, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন শোভনের বাড়ি, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেলের বাড়ি, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জামাল খানের বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
এছাড়াও তারা এসিল্যান্ডের কার্যালয়, জেলা পরিষদ, পৌরসভা কার্যালয়, জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয়, পৌর মিলনায়তন, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসন আয়োজিত দুই দিনব্যাপী উন্নয়ন মেলার প্যান্ডেল ভাঙচুর করে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, হামলাকারীরা বিজিএফসিএলের কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী মন্টুর বাসভবন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব, পৌর মেয়র মিসেস নায়ার কবিরের বাসভবন, সরকারি গণগ্রন্থাগার, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, মাতৃসদন, হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে পুরাতন ও প্রধান মন্দির আনন্দময়ী কালীবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর করে। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধু স্কয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালও ভাঙচুর করে।
মোকতাদির চৌধুরী জানান, শুক্রবার তাণ্ডব চালিয়ে তারা সার্কিট হাউসের সামনে রাখা ডিসিপুলের ৯টি গাড়ি, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা মৎস্য অফিস, সিভিল সার্জনের কার্যালয় ভাঙচুর করে। হামলাকারীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি রিয়াজউদ্দিন জামিকে হত্যার উদ্দেশে মারধর করে। আরও অনেক সাংবাদিককে নাজেহাল করে বলেও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, হামলা-তাণ্ডবের সময় প্রশাসন নিরব ছিল। ফায়ার সার্ভিসের কোনও ভূমিকা ছিল না। প্রশাসন একটু সক্রিয় হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কম হতো।
তিনি জানান, হামলার সময় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সদর থানার ওসি, পুলিশের আইজিপি, কেবিনেট সেক্রেটারিসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী অনেক আমলার সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু কোনও সাহায্য পাননি।
হামলার সময় কেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় ছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে সংসদ সদস্য মোকতাদির বলেন, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। এর আগে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হওয়া তাণ্ডব এবং নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার যদি বিচার হতো তাহলে গত শুক্রবার ও রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলা করতে তারা সাহস পেত না।
তিনি আরও বলেন, আমরা যদি দলীয়ভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করতাম, তাহলে অনেক রক্তপাত হতো। আমরা রক্তপাত এড়াতে চেয়েছি। হামলার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে প্রশাসন কেন ভূমিকা নিল না, তাদের স্ব-স্ব ডিপার্টমেন্টাল তদন্ত করার দাবি জানান উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।
‘আমার সারা জীবনের অর্জন বিভিন্ন নথিপত্র সব তারা পুড়িয়ে ফেলেছে’
মতবিনিময় সভায় আল মামুন সরকার বলেন, রোববার হরতাল পালনের সময় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ তাঁর (আল মামুনের) কার্যালয় ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর এবং গানপাউডার ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলার সব প্রমাণ রয়েছে। পৌরসভা থেকে ১০ হাত দূরে ফায়ার স্টেশন কিন্তু আগুন নেভাতে তাঁদের কেউ আসেননি।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন আল মামুন সরকার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার অফিসে আমার সারা জীবনের অর্জন বিভিন্ন নথিপত্র ছিল। সব তারা পুড়িয়ে ফেলেছে। কোনো দিন এসব আর ফেরত পাব না। আমি সরকারের কাছে জানতে চাই, কেন প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারল না? কেন তারা হামলাকারীদের ঠেকাতে পারল না? কেন প্রশাসনের এই নীরবতা? আর প্রশাসন বলেছে, তারা কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সরাইল বিশ্বরোড মোড় থেকে কাউতলী পর্যন্ত রক্ষা করেছে।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থান পরিদর্শন করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা তদন্তের জন্য চট্টগ্রামের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছেন।
ডিআইজি আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ভিডিও চিত্র ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দুটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করবে। তিন দিন ধরে পুলিশ ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকা, তথ্য প্রদানে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশ মাঠেই ছিল। রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা ছিল, তাই কোথাও পৌঁছাতে দেরি হয়েছে।
আর চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ বলেন, প্রশাসন তার স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিষয়ে সাংসদের তদন্তের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তদন্তের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি।