দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আবার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দিন দিন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে অদৃশ্য ভাইরাসটি। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্ত এবং আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ক্রমেই বেড়ে চলছে। মার্চের প্রথম ও শেষ ১৫ দিনের মধ্যে আক্রান্ত-মৃত্যুর তুলনামূলক চিত্রে আকাশপাতাল পার্থক্য দেখা গেছে। গত কয়েক মাস মাস্ক পরায় অনীহা, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্যমতে, মার্চের শুরু থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৯ হাজার ৭২১ জন। এই সময়ে মারা গেছেন ৫৮৬ জন। এর মধ্যে প্রথম ১৫ দিনে করোনায় প্রাণহানি হয় ১৬৩ জনের। আর মঙ্গলবার পর্যন্ত গত ১৫ দিনে ৪২৩ জন মারা গেছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথম ১৫ দিনের তুলনায় মৃত্যু বেড়েছে ২৬০ শতাংশ।
অন্যদিকে আক্রান্তের হিসেবে মার্চের প্রথম ১৫ দিন যেখানে ১৩ হাজার ১৫ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছিল, সেখানে শেষের ১৫ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬ হাজার ৬৯৭ জন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রথম ১৫ দিনের তুলনায় শনাক্ত বেড়েছে ৩৫৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের ২৯টি জেলা করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে করোনা সংক্রান্ত কমিটিকে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। গত বছরের ৩০ নভেম্বরের পর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে সংক্রমণের হার ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। কিন্তু মার্চের শুরু থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগী, মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।
দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৫ লাখ থেকে সাড়ে ৫ লাখ হতে যেখানে ৭৭ দিন সময় লেগেছিল, তা ৬ লাখে পৌঁছাতে সময় নিয়েছে মাত্র ২২ দিন।
গত দুদিন ধরে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচ হাজারের ওপরে থাকার পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হারও থাকছে ১৮ শতাংশের বেশি, যা গত ২৪ আগস্টের পর সর্বোচ্চ। নতুন করে করোনার সংক্রমণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় গত সোমবার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ সব ক্ষেত্রে সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করাসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্চের শুরু থেকেই দেশে করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। ক্রমেই এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি না মানলে সামনে সামনে আরও খারাপ অবস্থা হতে পারে। করোনা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারের জারি করা ১৮ দফা নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্চের প্রথম সপ্তাহের তুলনায় দ্বিতীয় সপ্তাহে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। পরের দুই সপ্তাহের চিত্র আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করে। মার্চের ১৫ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত আটদিনে আক্রান্ত হয় ১৬ হাজার ২৯২ জন। আর মারা যায় ১৭৫ জন। সেখানে গতকাল পর্যন্ত শেষ আটদিনে আক্রান্ত হয় ৩২ হাজার ২০৮ আর মারা যায় ২৭৪ জন।
সংক্রমণের ঝুঁকিতে যেসব এলাকা
করোনা ভাইরাসের এমন প্রকোপের মধ্যে দেশের ২৯টি জেলাকে সংক্রমণের হার বিবেচনায় ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ২০ জেলায় সংক্রমণের হার অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা।
জেলাগুলোর নাম বিস্তারিত না বললেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত জেলার মধ্যে ঢাকা ছাড়াও আছে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী, চাঁদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, গাজীপুর, শরীয়তপুর, নীলফামারী, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ি, খুলনা, নরসিংদী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, মাদারীপুর, নওগাঁ ও রাজশাহী।
সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা দেখেছি, প্রথম দিকে নতুন করে করোনা সংক্রমণের জেলা ছিল ছয়টি। ২০ তারিখে সেটি হয়েছে ২০ এরপর ২৪ তারিখে পেয়েছি ২৯ জেলায়। সুতরাং করোনা সংক্রমণ বেড়েই যাচ্ছে।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ কমিটি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে কী ব্যবস্থা নেওয়া সেটি নিয়ন্ত্রণ কমিটি ঠিক করবে। তবে আমরা বিষয়টি মনিটরিং করব।’
এদিকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মানুষকে সচেতন করতে প্রচার প্রচারণা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাওয়ার পর মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি তোয়াক্কা না করার ফল এখন দেখতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারকে একদিকে কঠোর হতে হবে আবার মানুষকেও পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি নামার ক্ষেত্রে সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে আক্রান্তদের আইসোলেশন করা এবং তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে।’