জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই হেফাজত মাঠে নেমেছে: ইসলামী ঐক্যজোট

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

বাংলাদেশ ইসলামি ঐক্যজোট

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশ জুড়ে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে হুকুমদাতাদের গ্রেপ্তার ও মূল হোতাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট।

আজ শনিবার দুপুরে, জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন থেকে সংগঠনটির চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামি কওমী অঙ্গনের বেশ কিছু আলেমকে অর্থের বিনিময়ে কিনে নিয়েছে। তাই জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই হেফাজত মাঠে নেমেছে। দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টিকরা হেফাজতের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো।

universel cardiac hospital

হেফাজত নিয়ে সরকারের চোর-পুলিশ খেলা দেশবাসী পছন্দ করছে না বলেও সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন মিছবাহুর রহমান।

উগ্রবাদীদের মাধ্যমে কওমী মাদরাসার নিরীহ ছাত্রদের কেউ যেন হয়রানির করতে না পারে, সেজন্য সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়।

জোটের পক্ষে ১০টি দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো:

১) ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মসূচি পালনকালীন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে মানুষ হত্যার উস্কানিসহ মধ্যযুগীয় তাণ্ডব সৃষ্টিকারীর হুকুমদাতাদের গ্রেপ্তারর, প্রকৃত মাস্টারমাইন্ডদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।

২) একজন বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে বছরব্যাপী ওয়াজের নামে হেলিকপ্টার সওয়ারিদের আয়ের উৎস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তাদের বক্তব্য ও অপতৎপরতার তদন্ত এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারী হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনাসহ সার্বিক ঘটনাবলী তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত জনসম্মুখে প্রকৃত কাহিনী প্রকাশ করতে হবে।

৩) গোটাকয়েক উগ্রবাদীর কারণে কওমি মাদ্রাসাগুলোর কোন নিরীহ ছাত্র যাতে হয়রানির শিকার না হয় সে দিকে কঠোর নজর রাখতে হবে।

৪) হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা আহমদ শফির হত্যা মামলার তদন্ত দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।

৫) ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় যারা অনুপ্রবেশকারীদের ষড়যন্ত্রে বিভিন্ন মামলার আসামি হয়েছেন তাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনে হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মামলা ছাড়া সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

৬) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় চাকরিরত দারুল আরকাম মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া অন্যায়ভাবে দৈনিকভিত্তিতে কর্মরত বেশকিছু কর্মচারীর বেতন-ভাতা বন্ধ রেখে তাদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও এখনও তাদের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়নি। এসব কর্মচারীদের দ্রুত বেতন ভাতা পরিশোধ করতে হবে।

৭) প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি স্কুলে এবং এ ব্যাপারে পিছিয়ে পড়া কওমি ওলামাদের প্রধান্য দিতে হবে। শিক্ষক দিতে হবে।

৮) দেশের সবকটি মসজিদের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে এবং মসজিদগুলোকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোরআন শিক্ষা ও মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৯) কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা সিলেবাস, পাঠদান, পাঠ্যক্রমকে মূল ধারা বজায় রেখে আরও যুগোপযোগী করার ব্যবস্থা করতে হবে।

১০) চিহ্নিত উগ্রবাদীদের সঙ্গে বেশকয়জন প্রভাবশালী সরকারি লোকজনের ঘনিষ্টতার কারণে উগ্রবাদীদের ঔদ্ধত্য আচরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই উগ্রবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কিত ২-৪ জন প্রভাবশালী সরকারি ব্যক্তির ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।

এ সময় সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা তাজুল ইসলাম, মাওলানা শিহাব উদ্দিন, সদস্য সচিব মাসুদুর রহমান, মহাসচিব মনিরুজ্জামান রব্বানী প্রমুখ।

উল্লেখ্য, গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস ও স্থাপনায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় অনেক বাড়িঘর। রেলস্টেশন থেকে থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, হিন্দুদের উপাসনালয়, ভূমি অফিস- বাদ যায়নি কিছুই। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে সুরসম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনও। হামলার টার্গেট ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোও। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির প্রতি ছিল তীব্র ক্ষোভ। প্রতিটি প্রতিকৃতিই খুঁচিয়ে নষ্ট করা হয়েছে। বলতে গেলে ওই তিন দিন যেন একাত্তরেরই খণ্ডচিত্র প্রত্যক্ষ করেছে জেলাবাসী। রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল ব্রা‏হ্মণবাড়িয়া।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রা‏হ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডবের জন্য প্রধানত দায়ী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। প্রথম দিন ২৬ মার্চ হেফাজতের নেতাকর্মীরাই তাণ্ডব চালিয়েছে। রেলস্টেশনসহ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, জেলা মৎস্য ভবনে হামলা ও ভাংচুর চালায় ওরা। পরের দুদিন হেফাজতের সঙ্গে যোগ দেয় অন্যরাও।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ধ্বংসযজ্ঞের দ্বিতীয় দিন হেফাজতের সঙ্গে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন জামায়াত-শিবিরসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী একটি গ্রুপও ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ভিডিও ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে ইতোমধ্যে তাণ্ডবের মদদদাতাদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ২৬ মার্চ ঢাকা ও চট্টগ্রামে মোদিবিরোধী কর্মসূচিতে হামলার অভিযোগে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ব্রা‏হ্মণবাড়িয়া শহরের সিরাজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ও হেফাজতে ইসলামের জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক বোরহান উদ্দিন আল-মতিনের নেতৃত্বে প্রথম মিছিল বের হয়। একই সময় স্থানীয় বড় মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ার শিক্ষক ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও জেলা সভাপতি মাওলানা সাজেদুল ইসলাম ও জেলা সেক্রেটারি মোবারক উল্লাহর নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল বের হয়। স্থানীয়রা বলছেন, এই দুই মিছিল থেকেই প্রথম দফায় হামলা-ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়।

স্থানীয় আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, হেফাজতের জেলা কমিটিতে দুটি ভাগ রয়েছে। একটি পক্ষ মাওলানা সাজেদুলের অনুসারী। আরেক দল আব্দুর রহিম কাশেমীর অনুসারী। হেফাজতের মূলধারার নেতাকর্মীরা যখন বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে, তখন কাশেমীর অনুসারীরা রেলস্টেশনে আগুন দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে হেফাজতকর্মীদের দেয়া আগুন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে হেফাজতকর্মীদের দেয়া আগুন।

ব্রা‏হ্মণবাড়িয়ার ঘটনার অনুসন্ধানকারী বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, দ্বিতীয় দিনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে নন্দনপুর এলাকায় হেফাজতের সঙ্গে যোগ দেয় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। প্রায় একই সময় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা এলাকায় আওয়ামী লীগের একটি মিছিলকে কেন্দ্র করেও সংঘর্ষ শুরু হয়। আর তৃতীয় দিনের হরতালকে কেন্দ্র করে হেফাজতের সঙ্গে জামায়াত-শিবির, বিএনপির নেতাকর্মীরা মিলেমিশে তাণ্ডব চালায়।

জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার আশপাশের এলাকা বিএনপি অধ্যুষিত। এ কারণে আওয়ামী লীগের একটি মিছিলকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসা ও আশপাশের মসজিদ থেকে মাইকিংও করা হয়। মিছিল ঠেকাতে একযোগে লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে পড়তে বলা হয় সবাইকে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, তৃতীয় দিনের হামলা ছিল পরিকল্পিত। এদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভাংচুর করা হয় জেলা পরিষদ ভবন, পৌরসভা ভবন, পৌর মিলনায়তন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, পুলিশ লাইন, সদর থানা, খাঁটি হাতা বিশ্বরোড হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, শহরের কেন্দ্রীয় মন্দির শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালী বাড়ি, দক্ষিণ কালী বাড়ি, জেলা আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্যের কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের কার্যালয়, তার নিজের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার চত্বর ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন। হামলাকারীরা সিসিটিভি ক্যামেরাও খুলে নেয়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথম দিন থেকেই হেফাজতের আন্দোলনকে বেগবান করতে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন স্থানীয় জামায়াত নেতা ডা. ফরিদ। জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি মনির হোসেনের ভাই ঠিকাদার মুক্তার হোসেনও অর্থ সহায়তা দিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মুক্তার এলাকায় কওমিপন্থী বলে পরিচিত।

শেয়ার করুন