২৬মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক ঘটনা। এই দিনে সমগ্র জাতির সঙ্গে মিলে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর প্রত্যেক স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ অত্যন্ত আনন্দ ও উদ্দীপনায় উদযাপন করছিলো মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। কিন্তু কেবল ব্যতিক্রম ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি তথা পাকিস্তান প্রেমী মানুষেরা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে হাতিয়ার বানিয়ে প্রাণের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ তাণ্ডব চালায় উগ্রবাদী ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের (প্রকৃতপক্ষে খারেজি) নেতা মামুনুল হকের অনুসারীরা। মাঠপর্যায়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা সাজিদুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাধারণ সম্পাদক ও জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতি মোবারক উল্লাহ গংরা। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে সারাদেশসহ বিশ্ববাসী দেখেছে তাদের বর্বরতার চিত্র। পাশাপাশি দেশবাসীর নিকট উন্মোচিত হয়েছে তাদের আসল চরিত্রও। কেননা ধর্মকে পুঁজি করে তারা এদেশকে যে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, এই বিষয়টিও ইতোমধ্যে জনগণ জেনে গেছেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী অসহায়ের মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি, সাজিদুর-মোবারকের নির্দেশে তাদের প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীদের দ্বারা পরিচালিত তাণ্ডবলীলা। হেফাজতি দানবেরা যখন সেদিন আগুন দিয়ে আমাদের সকলের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম রেলস্টেশনকে পুড়িয়ে দিচ্ছিলো, যখন ভেঙে ফেলছিলো জাতির প্রেরণার বাতিঘর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, আক্রমণ করেছিলো জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পুলিশ সুপারের বাসভবন, জেলা জজের বাসভবন, সিভিল সার্জন অফিস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় এবং তছনছ করছিলো ঐসব স্থাপনা সংলগ্ন ফুলের বাগান। বিশেষ করে তারা যখন শহরের ফারুকী পার্কে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এক সাগর রক্ত বিসর্জন দেওয়া মহান বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে প্রেরিত পুষ্পার্ঘ্য স্তবকসমূহকে পা দিয়ে মাড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছিলো তখন একবারের জন্যেও আমাদের কাছে তাদেরকে (হেফাজতি) আলেম বলে মনে হয়নি। তখন মনে হচ্ছিল ওরা একাত্তরের হয়েনাদের রেখে যাওয়া শাবকের দল। এই হায়েনা শাবকদের পরাজিত পূর্বপুরুষেরা ধর্মকে পুঁজি করেই আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে যেভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি-ঘর, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসে মেতে উঠেছিল, ঠিক তেমনিভাবেই তাদের রেখে যাওয়া শাবকেরাও সরকারি দল কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই একাত্তরের প্রতিশোধ নিতে বেছে নিয়েছিল ২৬ মার্চকে।
সেদিনের তাণ্ডবে মোদী ছিলেন উপলক্ষ মাত্র, কার্যত হেফাজত একাত্তরের পাকিস্তান সমর্থক রাজাকারের উত্তরসূরি হিসেবে দেশের রাষ্ট্র ও সংবিধানকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রে বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। তারা অস্বীকার করছে রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে। এরা বহু আগে থেকেই জাতীয় সংগীত, জাতির পিতাকে অস্বীকার করে আসছে। এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকাও উত্তোলন করা হয় না। আমরা মনে করি, সাম্প্রতিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হামলার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দিয়েছে যুদ্ধের একটি আগাম বর্তা। তারা আরও জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তারা এখনও মেনে নেয়নি। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় এখনও তাদের মর্মযাতনার শেষ নেই। এখনও তারা গোলাম আযম, সাঈদী, আজিজুল হকের চিন্তা-চেতনাকে পোষণ করে। তারা এখনও চায় বাংলাদেশ পাকিস্তানি ভাবধারায় চলুক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে দেশজুড়ে সহিংসহতা চালিয়ে হেফাজতিরা যে যুদ্ধের বার্তা দিয়েছে তা হলো- ‘সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বনাম অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ’। কাজেই রাষ্ট্রের কল্যাণ ও টেকসই বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই এবং এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল শক্তিকে একাত্তরের মতো এগিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো- হেফাজত যে একের পর এক তাণ্ডব চালিয়ে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ বিনষ্ট করছে, এসবের বিচার হচ্ছে না কেন? জনগণের জানমাল হেফাজতের দায়িত্ব যে সরকারের, তারা কী করেছে? সরকার কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারল না? পুলিশপ্রধান ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, যারা জনগণের সম্পদ ধ্বংস করেছে, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়, পুলিশ প্রধানের ঘোষণার পরও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার প্রত্যক্ষ মদদদাতা মাওলানা সাজিদুর রহমান ও মোবারক উল্লাহকে এখনও কেন হুকুমের আসামি করা হল না? কেন তাদেরকে এখনও গ্রেফতার করা হচ্ছে না? এসব সন্ত্রাসীরা কীভাবে এখনও শহরের প্রেসক্লাবে বুক চিতিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন?
হেফাজতিদের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে এখনও যেমন একজন সাহসী জনপ্রতিনিধি হিসেবে একাই প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী; দাবি করেছেন বিচারবিভাগীয় তদন্ত। ঠিক এর আগেও ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি যখন হেফাজতিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্তরসহ বিভিন্ন স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়েছিল তখনও তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ঐ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছিলেন। আমাদের প্রশ্ন হলো- সেসময় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল তার অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে? কেন এখন পর্যন্ত আদালতে ঐ মামলার চার্জশীট দেওয়া সম্ভব হয়নি? কাদের ইসারায় আটকে আছে তদন্ত?
আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী সকলেই জানি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক ও মুজিবাদর্শে সৈনিক। তিনি কখনোই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন না। তিনি এই শহরের সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধারে সবসময় কাজ করার পাশাপাশি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এই অসাম্প্রদায়িক মানুষটির শত লড়াই-সংগ্রামের পরও কেন অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে? তবে কী এখানে আড়াল থেকে অন্য কেউ কল-কাঠি নাড়ছেন?
দেশের শান্তিপ্রিয় সকল মানুষই মনে করেন, হেফাজত একটি ধর্মান্ধ উগ্রবাদী শক্তি। এই সংগঠনটি স্বঘোষিত মুক্তিযুদ্ধেরবিরোধিতাকারী প্রয়াত মাওলানা আজিজুল হকের মতাদর্শে বিশ্বাসী (যিনি বাংলাদেশকে তালেবানী রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন এবং তালেবানদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে ১৯৯৭ সালের দিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আহ্বান করেছিলেন)। আর বর্তমান হেফাজতের নেতৃত্বেও রয়েছেন তার পুত্র মামুনুল হক। কাজেই এটি মাথায় রাখা উচিত, হেফাজত আর যা-ই হোক আওয়ামী লীগের মিত্র হবে না। সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগকেই ছোবল মারবে। কেননা হেফাজতের আড়ালে আবার স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠী নীরবে ডালপালা মেলছে।
সবশেষে সরকারের কাছে আমাদের দাবি, এই উগ্রবাদী ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে এদের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করুন। বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতা উসকে দেওয়ার অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা সাজিদুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাধারণ সম্পাদক ও জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতী মোবারক উল্লাহসহ সকল অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করুন। অন্যথায় এ ধরনের বর্ববরতা প্রতিনিয়তই ঘটতে থাকবে।
লেখক: সিনিয়র সাব-এডিটর, মত ও পথ এবং সাবেক ছাত্রনেতা।