করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। গত বছরও তিন মাসের লকডাউন দেওয়া হয়েছিল। এবার করোনা আক্রান্তের হার ও মৃত্যু সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায় সংক্রমণ ও মৃত্যু কমিয়ে আনতে হলে কঠোর লকডাউনের কোনও বিকল্প নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে তারা বলছেন, লকডাউনের সুফল যেমন রয়েছে, তেমনই দেশব্যাপী এই অচলাবস্থার কারণে কোটি কোটি টাকার ক্ষতিও হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কঠোর লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বহুমাত্রিক।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, লকডাউন দেওয়া হলে অর্থনীতির সব খাতই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লকডাউনের ফলে কোনও কোনও খাত সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়ে, আবার কোনও কোনও খাত লকডাউন তুলে নেওয়ার পর ক্ষতির মুখে পড়ে।’ তার মতে, লকডাউনে ছোট উদ্যোক্তারা সরাসরি এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েন। ছোট ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়লে তাদের পরিবারও বিপদে পড়ে। আর বড় উদ্যোক্তারা সরকারের সুবিধা নিয়ে টিকে থাকলেও সেখানেও ছন্দপতন দেখা যায়। অনেক কর্মচারী চাকরি হারান। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির নিজস্ব হিসাবে সারা দেশে গত বছরের লকডাউনে ৫৩ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের দৈনিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এবছরও ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সমান বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, গত বছর লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র ব্যবসা খাত। এবছরও প্রতি দিনের লকডাউনে প্রায় সমান ক্ষতি হচ্ছে। এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫৩ লাখের বেশি। এদের পুঁজির পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা। গত করোনায় লকডাউনে তারা সব পুঁজি নষ্ট করেছেন। এই ক্ষুদ্র ব্যবসা খাতের উদ্যোক্তারা কোনও প্রণোদনা পাননি। নিজেরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়া ছোট ব্যবসায়ীরা লকডাউন তুলে দেওয়ার জন্য বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছেন। এদিকে লকডাউন দীর্ঘায়িত না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দোকান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান টিপুর সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, আজকে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ঠিকমতো বাজার করে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে পারছেন না। আজ তাদের কাছে নগদ টাকার বড়ই অভাব।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, লকডাউনের সময়সীমা বৃদ্ধি পেলে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ড. জায়েদ বখত মনে করেন, গত বছরের মতোই এবারও লকডাউনে সেবা খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশ্য সরকারের প্রচেষ্টায় গতবছর করোনা মোকাবিলায় ভালো রেজাল্ট এসেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে করোনা বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে নতুন করে ভাবতে হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে স্বাস্থ্য খাতের ওপর।
তার মতে, স্বাস্থ্য খাত ভালো থাকলে অন্যান্য খাতও ভালো থাকবে। আর স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, সব খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
যদিও করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় চলমান লকডাউনে কোন খাতে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তার কোনও হিসাব সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এখনও পর্যন্ত করা হয়নি।
তবে গত বছরের তিন মাসের লকডাউন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে সেই সময়কার লকডাউন চলাকালে প্রতি দিন ক্ষতির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি।
এদিকে করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল যে লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার, তাতে সব ধরনের কল-কারখানা চালু রয়েছে। অফিস খোলা রয়েছে। নগরীতে যানবাহনও চালু রয়েছে। অর্থাৎ, গত বছর করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের হার কম থাকলেও লকডাউন ছিল কঠোর। কিন্তু এবার আক্রান্ত ও মৃত্যু প্রতিনিয়ত বাড়লেও লকডাউন অনেকটাই শিথিল।
গত বছর প্রথম একমাসের লকডাউনে বাংলাদেশ কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তার একটি ধারণা দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য-অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষক দল।
তাদের হিসাবে, ২০২০ সালের লকডাউনের প্রথম একমাসে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ‘অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এই হিসাব দেন তারা। গবেষক দলের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি ওই সময় জানিয়েছিলেন কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে গড়ে মোট অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত— কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত ধরে ক্ষতির অনুমিত হিসাব করা হয় ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করে সেবা খাতে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বেচা-কেনা এবং জরুরি সেবা ছাড়া এই খাত মূলত অবরুদ্ধ। সব ধরনের যোগাযোগ (সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথ), পর্যটন, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, রিয়েল এস্টেটসহ সব ধরনের সেবা বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে সেবা খাতে প্রতি দিনের অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা।
তাদের হিসাবে শিল্প খাতে প্রতি দিন ক্ষতি হচ্ছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে প্রতি দিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে ২০২০ সালের প্রতি দিন কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। কৃষির প্রধান উপখাতগুলো হলো— শস্য উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ। স্বল্প মেয়াদে এই সব উপ-খাতে উৎপাদন না কমলেও দেশি-বিদেশি অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকায় এসব উপ-খাতের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের ওপর নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।