স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এবার ২৬ ও ২৭ মার্চ আরেক একাত্তর নেমে এসেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ১৯৭১-সালে এই শহরটিকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। এবার ৫০ বছরের মাথায় এসে শহরটি আবার ছাই হয়েছে পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা। এর আগে এই হেফাজতের সৈনিকরা রাজধানীর মতিঝিল ও এর আশপাশ এমন তালেবানী কায়দায় জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, হেফাজত নিজেকে যতই ইসলামের হেফাজতকারী অরাজনৈতিক সংগঠন বলুক না কেন, এটি আদতে একটি উগ্রবাদী ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন, যার মূল দর্শন ভারত বিরোধী সাম্প্রদায়িক নীতি। হেফাজত নেতাদের নামে ফেসবুকে কোন কিছু লিখে আজ হেনস্তার শিকার হচ্ছেন অসাম্প্রদায়িক মানুষ, এমনকি ছাত্রলীগ বা যুবলীগের নেতা কর্মীরা। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতায় হেফাজত, আর আওয়ামী লীগের আমলে আওয়ামী লীগ নিজে ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বিরোধী অবস্থানে।
এগুলো নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, হবেও। কিন্তু ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাস এতটা প্রত্যক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে রাজনীতিতে, তা বোধহয় আগে কেউ ভাবতে পারেনি। ধর্মীয় বিশ্বাস যে কোনও ব্যক্তির নিতান্ত ব্যক্তিগত পরিসরের বিষয়। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সেক্যুলার বলে যেসব নেতাদের চিনতাম তারাও দেখছি ধর্মীয় বিশ্বাস স্পষ্ট করে সর্বসমক্ষে তুলে ধরার এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশ যে পাকিস্তানের পথে হাঁটতে শুরু করে, সেখান থেকে যেন আর ফেরানো যাচ্ছে না। গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তাও জাতির পিতার কন্যার হাত ধরে, কিন্তু তবুও যেন তালেবানী রাজনীতির বাড় বাড়ন্ত। যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু কোথায় যেন একাত্তরের রাজনৈতিক দর্শনের একটা বড় আওয়াজ তোলার অভাব। ওয়াজ আর মাহফিলে যাওয়া বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল ছিল। কিন্তু এখন যেন আওয়ামী লীগও সেই রাজনীতিতে ভাগ বসাতে চেয়েছে এবং বেশি করে বসাচ্ছে। সেই স্বৈর শাসকদের মত আওয়ামী লীগ নেতারাও মাজার থেকে নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরু করেন। বেশিরভাগ ওয়াজ মাহফিলের পৃষ্ঠপোষক আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতারা। নেতারা উদ্বোধন করে চলে যাবার পর জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বর্তমান সরকার বিরোধী বক্তব্য চলতে থাকে এসব মাহফিলে। যে সামাজিক মাধ্যমকে এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি ইহুদি নাসাদের সৃষ্টি বলে দিনরাত গালাগালি করে, সেই প্লাটফর্ম ব্যবহার করেই তারা আজ দেশব্যাপী দাঙ্গা করছে।
রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক এত নিবিড় হবে কেন? যে ধর্ম একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, সেটা কেন রাজনীতির পরিসরে এত বড় হয়ে দেখা দিবে? এই প্রশ্নের উত্তর সেখানেই যখন আমরা দেখি উদারনৈতিক রাজনীতির দাবিদার দলের নেতাদের ধর্মীয় আচার আচরণ নিয়ে রাজনীতিতে খুব বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করার প্রয়াস চলছে। যে কেউ মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় যেতে পারেন, এটার তার ব্যক্তিগত অধিকার। তিনি কোথায় যাবেন, কোথায় যাবেন না, তা তিনি নিজেই স্থির করবেন। এ নিয়ে অন্য কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এর বিপরীতটা ঘটছে। নেতা নামাজ পড়লেন কিনা, নেতা ধর্মীয় সভায় যোগ দিলেন কিনা, হজ করলেন কিনা, রাজনীতির আঙিনায় তা যেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমরা বুঝতেও পারছি না যে কট্টরবাদীরা এই রাজনীতিটাই চায়। এমন কি রিসোর্টে মামুনুলের নারীসহ ধরা পড়ায় বা অন্যান্য ইস্যুতে যখন সেক্যুলাররা সুরা আর হাদিস থেকে বয়ান করেন, তখন জয় হয় তাদেরই যারা দেশটচাকে ধর্মীয় লেবাসে দেখতে চান। উগ্র, সাম্প্রদায়িক শক্তির ফাঁদে অন্য দলের পা দেওয়া হচ্ছে এভাবেই।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে কোথায় মানুষ আরও উদার, আরও খোলামেলা পরিবেশে নিজেদের মেলে ধরবে, তা নয়। বরং দেখছি সর্বত্র কট্টর রাজনীতির জয়। আমাদের রাজনীতির অভিমুখটাকে কেন এত সঙ্কীর্ণ দিশায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে, সেখানে কার কতটুকু দায় সে প্রশ্নটা ওঠা উচিত।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল সেই প্রভাবশালীরা ধর্মের কথা টেনে এনে দেশটাকে ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখন কেন আমরা সেই ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারছি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
২০১৩ থেকে ২০২১– আটটি বছর। হেফাজত বদলায় নি, যদিও তাদের কথায় পাঠ্যবইকে বদলে ফেলে বেশি করে প্রতিক্রিয়াশীল করা হয়েছে। তারা আরও শক্তি সঞ্চয় করেছে। আরও পরিসর বেড়েছে তাদের। এবং তারা পেরেছে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে। ধর্মীয় কথার প্যাঁচে ফেলে উদারপন্থীদের নাস্তানাবুদ করার জুলুমবাজি চলছে দেশে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জন্য সাধারণ মানুষের কথা বলায় কত সতর্কতা। সারাক্ষণ কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয় মানুষকে। কিন্তু যারা ধর্মের নামে নিয়ত দেশকে, বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযুদ্ধে কটাক্ষ করছে তারা আরামে আছে। কিছু হয় না তাদের।
রাজনীতি এসব ক্ষেত্রে অনেক বেশি পরিপক্কতা দাবি করে। আমরা চাই সেই পরিবেশ যেখানে রাজনৈতিক দল নেতা নেত্রীদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসকে রাজনীতির জড়িয়ে রাজনীতি করবে না। রাজনীতির জন্য এ মোটেই স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়। এসবকে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়েই দেশের রাজনীতির চেহারাটা বদলে গেছে। ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টাটা নতুন করে সচেতন ভাবে শুরু হোক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পাক প্রেতাত্মাদের সহিংসতা থেকে আমরা যেন সেই তাগিদটুকু অনুভব করি।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।