ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে যখনই নির্বাচন হয় তখন সীমান্ত পারের প্রতিবেশী বাংলাদেশ কোনও না কোনওভাবে অল্পবিস্তর তাতে প্রভাব ফেলেই থাকে। কিন্তু ওই রাজ্যে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ যেভাবে আগাগোড়া আলোচনার কেন্দ্রে, অতীতে এমন কোনও নজির নেই বললেই চলে।
নানা কারণে আর নানা পরিপ্রেক্ষিতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি এবার প্রায় সব দলের রাজনীতিবিদদেরই মুখে মুখে ফিরছে। সেটা কীভাবে, এই প্রতিবেদনে তা-ই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বস্তুত বাংলাদেশ যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠতে চলেছে, সেই ইঙ্গিত ছিল প্রায় বছর দেড়েক আগে পাস হওয়া ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-তেই। ওই আইনে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান থাকলেও মুসলিমদের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, যার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই শুরু হয় তুমুল বিক্ষোভ ও ধরনা। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল।
সিএএ (এবং সেই সঙ্গে প্রস্তাবিত এনআরসি বা আসামের ধাঁচে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী) নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে তখন থেকেই। বাংলাদেশ থেকে যারা বহু বহু বছর আগেই ভারতে চলে এসেছেন, তাদেরও পরিচয়ের কাগজপত্রের জন্য হেনস্থা করা হবে এবং দরকারে ফরেনার্স ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হবে– মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল এই প্রচার শুরু করে তখন থেকেই।
অন্যদিকে বিজেপিও কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের বাস্তবায়ন আজও শুরু করতে পারেনি। যে হিন্দুরা এর ফলে লাভবান হবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল তারাও এতে হতাশ– এবং বিজেপি নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে এখন কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে যে করোনা মহামারির কারণেই তারা না কি ওই আইনের রূপায়ন শুরু করতে পারেননি।
এরই মধ্যে যখন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হব-হব করছে এবং তৃণমূলের বহু নেতা-মন্ত্রী বিজেপিতে গিয়ে ভিড়তে শুরু করেছেন, তখনই সেই নির্বাচনের ন্যারেটিভ বেঁধে দিলো বাংলাদেশের ডাকাবুকো আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের স্লোগান ‘খেলা হবে’।
একদা নারায়ণগঞ্জে তৈরি হওয়া এই ‘খেলা হবে’ আজও যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটকে মাতিয়ে রেখেছে তা দেখাই যাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে নরেন্দ্র মোদি তো বটেই– সব দলের ছোট-বড়-মেজো নেতারাই পাল্টাপাল্টি হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছেন ‘খেলা হবে’।
বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশের ইস্যু নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের ভোটে প্রতিবার কিছুটা চর্চা হয় – কিন্তু এবার যেনও তা আগের সব রেকর্ডকেই ছাড়িয়ে গেছে। ১১ ফেব্রুয়ারি কোচবিহার ও ঠাকুরনগরে দুটো জনসভা থেকে অমিত শাহ যেমন সোজাসুজি ঘোষণা করেন, ‘বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ থেকে মানুষ তো দূরস্থান – একটা পাখিও আমরা ঢুকতে দেব না!’
তখন থেকেই বিজেপির নেতারা নিয়ম করে বলতে শুরু করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল গত দশ বছর ধরে না কি ক্ষমতায় আছে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আর রোহিঙ্গাদের ভোটে জিতেই’।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ কিংবা শমীক ভট্টাচার্য-সায়ন্তন বসুর মতো পরের স্তরের নেতারাও প্রকাশ্য জনসভা থেকে বলতে থাকেন, ‘‘তৃণমূল আরও একবার জিতে এলে পশ্চিমবঙ্গ ‘ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। কিংবা রাজ্যের বৃহত্তর বাংলাদেশে পরিণত হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না’’!
এই বিতর্কের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পর্বের ভোটগ্রহণ শুরু হলো ২৭ মার্চ। ঠিক তার আগের দিন রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি– আর সেই সফর যেনও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিতর্কের আগুন উসকে দিল।
তৃণমূল নেত্রী মমতা সরাসরি অভিযোগ করলেন, নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে গিয়েও আসলে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে প্রচার চালাচ্ছেন। এমনও বললেন, ‘আগের নির্বাচনে একজন বাংলাদেশি তারকা (ফেরদৌস) এখানে আমাদের হয়ে প্রচার করায় তার ভিসা বাতিল হয়েছিল। এখন মোদি বাংলাদেশে গিয়ে এদেশের ভোটের প্রচার করছেন – তার কেন ভিসা বাতিল হবে না?’
বস্তুত নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে গিয়ে দুটি হিন্দু মন্দির সফর করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ও সেই সঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায়ের মন জিততে চেয়েছেন – কলকাতার বহু সংবাদমাধ্যমও এই বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিল।
এদিকে রাজ্যে ভোটের ঠিক আগে ভারতের বিতর্কিত টিভি উপস্থাপক অর্ণব গোস্বামী চালু করেছিলেন তার ‘রিপাবলিক টিভি’-র বাংলা সংস্করণ। পশ্চিমবঙ্গের ভোটে বাংলাদেশ প্রসঙ্গকে উসকে দিতে কারাও বড় ভূমিকা রাখছে।
দিনকয়েক আগেই তারা একটি ‘স্টিং অপারেশন’ চালিয়ে জানায়, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে দলে দলে ভোটার এসে না কি পশ্চিমবঙ্গে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন। ওই ভিডিওটি নদীয়া সীমান্তে তোলা হয়েছে বলে রিপাবলিক টিভি দাবি করেছে, তবে ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করা যায়নি। কিন্তু টিভিতে, ইউটিউবে ও সোশ্যাল মিডিয়াতে সেটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি ভোটার নিয়ে নতুন করে চর্চা জোরদার হয়েছে, বলাই বাহুল্য।
ফলে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এবার যে আলোড়িত – তা পরিষ্কার দেখাই যাচ্ছে। অথচ মজার ব্যপার হলো, পশ্চিমবঙ্গের যে ইস্যুটি নিয়ে বাংলাদেশে তীব্র আগ্রহ ও নজর আছে, সেই তিস্তা নিয়ে রাজ্যের ভোটে কোনও কথাই হচ্ছে না।
পশ্চিমবঙ্গের যে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে দিয়ে তিস্তা বয়ে গেছে, সেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার জল ভাগাভাগি কোনও নির্বাচনি ইস্যুই নয়। তিস্তার জল নিয়ে সেই অঞ্চলে কোনও পোস্টারও পড়েনি, তৃণমূল-বিজেপি-বামপন্থী কোনও দলের নেতাই তিস্তা নিয়ে জনসভায় কোনও কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছেন না!