হেফাজতের সাম্প্রতিক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে উদ্দেশ্য করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেছেন, যারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে টার্গেট করে তাণ্ডব চালায় এবং হাইয়্যালাল জিহাদ বলে সাধারণ মানুষকে ডাকে তাদের উদ্দেশ্য শুধু উদ্বেগজনকই নয় আশঙ্কাজনকও। তারা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তারা মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সঙ্গীত গায় না এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে না। কিন্তু কেন করে না এ কথাটি জিজ্ঞেস করার জন্য বাংলাদেশে কেউ নেই। দুর্ভাগ্যবশত এই কথাগুলো আমি একটুও বেশি বলি, আর সেজন্যই তারা আমাকে টার্গেট করেছে। তারা আমার নামে মিথ্যাচার করছে। তারা আমার জানাজা পড়বে না বলে হুমকি দিয়েছে। আমি বলেছি আমার জানাজা তারা না পড়ালেও চলবে, বরং আমার ওছিয়ত থাকবে হেফাজতিরা যেন আমার জানাজা না পড়ায়।
১৫ এপ্রিল এনআরবি নিউজ আয়োজিত ‘হেফাজতের তান্ডব ও নাগরিক উদ্বেগ’- বিষয়ক মুক্ত আলোচনায় যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক, বীরমুক্তিযোদ্ধা ডঃ নূরুন নবীর সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ডঃ মনসুর খন্দকার, ফাহিম রেজা নূর, জাকারিয়া চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, কেউ হেফাজতের প্রকৃত ক্যারেক্টার কেন জানি তুলে ধরে না। প্রথমেই আমি তাদের আসল ক্যারেক্টারটা তুলে ধরছি। হেফাজত যেখানে যেখানে মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না এবং জাতীয় সঙ্গীত সেখানে নিষিদ্ধ। সেখানে তারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে না। কিন্তু বাংলাদেশে যে যখন-ই ক্ষমতায় এসেছে আমরাসহ কেউই এটিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করিনি। এরসাথে যে একটা রাজনৈতিক দর্শন কাজ করছে এ কথাটি আমরা বুঝতে কখনো চেষ্টা করিনি। যার জন্য আমরা অনেক সময় তাদেরকে সাধারণ আলেম মনে করি। কিন্তু তারা একটি ফিলোসোফি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তাদের অন্যতম মুরব্বি প্রয়াত মাওলানা আজিজুল হক বলেছিলেন- ‘একাত্তরে আমাদের ভূমিকা ছিল নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, আমরা চাইনি পাকিস্তান ভেঙে যাক।’ এই নিরপেক্ষভাবে বিরোধিতা করা গোষ্ঠীটায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাদ্রাসাগুলো খুলে।
মত ও পথ সম্পাদক বলেন, এইবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে হামলা হয়েছে সেখানে লক্ষ্য করবেন, মাদ্রাসাগুলোতে মাইকে বলেছে হাইয়্যালাল জিহাদ। তারমানে তাদের ভেতরে জিহাদের আলোচনা হয়। তারা বিভিন্ন সময় জিহাদের কথা বলে এবং তাদের যে ছাত্ররা আছে, তাদেরকে তাদের ভার্সনের সে জিহাদের আহ্বান করে। কেননা ইসলাম ধর্মে মুসলমানের বিপক্ষে মুসলমানে জিহাদ করার কোনো বিধান নেই। কিন্তু তাদের ভার্সনের যে জিহাদ তারা সেটা করে। তারা সহজেই মানুষকে ভুল বুঝাতে পারে, যেহেতু তারা একেবারেই কোনো বাঁধাবিহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙার পর প্রতিবাদ মিছিল বের করলে এরজন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়! এজন্যই আমি বলেছি, ঘটনার মূল রহস্য বের করার জন্য একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক। কেননা সর্ষের ভেতরে কোনো ভূত আছে কিনা সেটি দেখা উচিত এবং সেই ভূত কী পরিমাণ আছে, অর্থাৎ সর্ষের পরিমাণ বেশি নাকি ভূতের সংখ্যা বেশি সেটাও একটু খুঁজে দেখা উচিত। কিন্তু বিচারবিভাগীয় তদন্তের কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত আমি পায়নি।
প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে ঘটনাটি ঘটেছে, ২০১৬ সালেও এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেসময় তারা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধ সংসদে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করেছিল। কিন্তু সেইটার কোনো বিচার হয় নাই। সেইটার বিচারের জন্য আমরা বারবার বলেছি, এগুলোর বিচার করা উচিত কিন্তু কী কারণে রাষ্ট্র তাদের বিচার করার ব্যাপারে অগ্রসর হয়নি এটা আমার জানা নেই। এরআগে আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব হয়েছিল। সেখানেও আমরা বলেছিলাম বিচারবিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য, আনফরচুনেটলি তখন এদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়নি
তিনি বলেন, এবারও কিন্তু তারা তারা দাবি তুলেছে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না এবং তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। মূলত এই ক্যারেক্টার নিয়েই ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনটিকে তারা বেছে নেয়।
পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা মোকতাদির চৌধুরী আরও বলেন, আমরা সকলেই যখন প্রায় ১টা পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি শেষ করে যার যার বাড়িতে ফিরেছি এবং আমি আমার গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি তখন হঠাৎ করে আমার কাছে ফোন যায়, সারাশহরে একটা তাণ্ডব চলছে। প্রথমেই তারা রেলস্টেশন পুড়িয়ে দেয়, ২০১৬ সালেও তারা রেলস্টেশন ভাঙচুর করেছিল কিন্তু এভাবে পুড়ায়নি। তারপর তারা পৌরসভায় আক্রমণ করেছে, বঙ্গবন্ধু চত্বরে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভেঙেছে, তারা হামলা চালায় ডিসির বাসভবন, এসপির বাসভবন, জেলা জজের বাসভবন, সিভিল সার্জন অফিস, জেলা মৎস্য অফিস, সার্কিট হাউস, পুলিশ ফাঁড়ি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২৬ তারিখ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুইজন নামীদামী মাওলানা সাজিদুর রহমান ও মোবারক উল্লাহ রাস্তায় ছিল এবং তাদের ছাত্রদেরকে নির্দেশ দিচ্ছিল।
তিনি বলেন, ২৭ তারিখ সকালে আগে থেকেই আমার জেলা প্রশাসন আয়োজিত উন্নয়ন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা ছিল, আমি ডিসিকে জিজ্ঞেস করলাম, সেখানে যাব কিনা। তখন তিনি বললেন আপনি নিশ্চয়ই যাবেন। আমরা আপনাকে নিয়ে যাব। আমি সেখানে বক্তব্য রাখি এবং তারপর আমাদের আর কোনো কর্মসূচি ছিল না। বিকেল ৪টায় আওয়ামী লীগের একটা আলোচনা সভা ছিল। আমরা সর্বসম্মতিক্রমে ঐ আলোচনা সভাকে প্রতিবাদ সভায় পরিণত করি। সেখানে আমাদের জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রস্তাব দিলেন আমরা একটা প্রতিবাদ মিছিলও বের করব, আমি দেখলাম হ্যাঁ, এটা একটা যুক্তিসঙ্গত কথা। কেননা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও বঙ্গবন্ধু স্কয়ার ভাঙার প্রতিবাদ অবশ্যই মিছিল করা উচিত। আমাদের প্রতিবাদ মিছিলটি যে রাস্তা দিয়ে সবসময় সচরাচর যায় সেই রাস্তা দিয়েই গিয়েছে। যদিও তারা অনেক সময় বলার চেষ্টা করে ঐ রাস্তা দিয়ে মিছিল যায় না। কিন্তু তাদের কথাটা মিথ্যাচার। আমরা যখন মিছিলটি নিয়ে দক্ষিণ কালীবাড়ি পার হচ্ছি ঠিক তখন পশ্চাৎ থেকে কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ পায়, তখন আমরা মিছিলটি দ্রুত শেষ করে চলে যায়। কিন্তু তখন থেকেই তারা মাইকে বলতে থাকে মাদ্রাসায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ আক্রমণ করেছে এবং বলতে থাকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ মুরতাদ, তাদের মোকাবিলা করতে হবে, হাইয়্যালাল জিহাদ।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, হাইয়্যালাল জিহাদ বলার মানেই হলো- তাদের একটা পূর্বপ্রস্তুতি ছিল, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে তারা দেশে একটা তাণ্ডব চালাবে। নতুবা ২৬ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালানোর কোনো কারণই ছিল না।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, ২৭ মার্চ রাতে জেলা প্রশাসন থেকে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারিকে বলা হলো- ২৮ তারিখ হেফাজত যে হরতাল ডেকেছে সেখানে আপনারা কোনো বাঁধা দিবেন না।এটা আমরা ট্যাকল দিচ্ছি কিন্তু তারা কোনো ধরনের ট্যাকল দেননি। সেখানে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শোভনের বাড়ি, ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেলের বাড়ি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি অর্থাৎ সবকিছু তছনছ করে দেয়। আমার বাড়িটি শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে কিন্তু সেখানেও তারা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু শেষমুহুর্ত তারা আক্রমণ করেনি বিধায় আমার বাড়িটি রক্ষা পায়।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ২৮ তারিখ শহর থেকে বিভিন্ন সময় আমাকে জানানো হয়েছে, আপনি হেল্প করুন আমাদেরকে কিন্তু হেল্প করার জন্য আমি জেলার সকল পদধারীকে ফোন করেছি কিন্তু হেল্প পায়নি। আমি যখন হোম মিনিস্টারকে ফোন দিলাম, তখন তিনি বললেন- ‘এটি তো আপনিই লাগিয়েছেন!’ আমি বললাম- আমি কীভাবে লাগালাম? তখন তিনি বললেন- ‘আপনি মিছিলটি না করলেই তো হত!’ আমি ওনাকে বললাম ঠিক আছে ২৭ তারিখ না হয় প্রতিবাদ মিছিল বের করার কারণে আজ তারা (হেফাজত) তাণ্ডব চালাচ্ছে। তাহলে তারা ২৬ তারিখ তাণ্ডব চালালো কেন? তখন তিনি বললেন- ‘.….তা অবশ্য ঠিক, তা অবশ্য ঠিক। ২৬ তারিখ এমনটা হলো কেন। ঠিক আছে আমি আপনাকে এক ঘন্টা পর ফোন করছি।’ কিন্তু আজকে পর্যন্ত ওনার এক ঘণ্টা আসেনি আরকি! আমরা কোথাও থেকে হেল্প পায়নি।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ করি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙার পর প্রতিবাদ মিছিল বের করলে এরজন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়! এজন্যই আমি বলেছি, ঘটনার মূল রহস্য বের করার জন্য একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক। কেননা সর্ষের ভেতরে কোনো ভূত আছে কিনা সেটি দেখা উচিত এবং সেই ভূত কী পরিমাণ আছে, অর্থাৎ সর্ষের পরিমাণ বেশি নাকি ভূতের সংখ্যা বেশি সেটাও একটু খুঁজে দেখা উচিত। কিন্তু বিচারবিভাগীয় তদন্তের কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত আমি পায়নি। আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনার ৪ দিন পর এখানে পরিদর্শনে এসেছিল, আমি তাদেরকেও বলেছি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরপ দুজন সংসদ সদস্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক মন্ত্রী ক্যাপ্টেন তাজের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু বিচারবিভাগীয় তদন্ত হবে কিনা তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নই। কিন্তু বিচারবিভাগীয় তদন্ত হয়ে সমস্ত ঘটনাকে যদি উদঘাটন করা না হয় তাহলে এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে এবং এটাকে কেউই বাঁধা দিতে পারবে না