ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজত কেউ করল না

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

যদি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই তাণ্ডবের আইনানুগ বিচার না হয়, অপরাধীরা বিচারের আওতায় না আসে তাহলে হেফাজত নিকট ভবিষ্যতে দেশব্যাপী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চাইতেও বেশি তাণ্ডব চালাতে সাহস পাবে। বিশেষত যারা সরকার উৎখাতের গোপন ষড়যন্ত্র করছে, তারা হেফাজতকে নিয়ে নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলতে সাহস পাবে।

আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংসলীলা সংগঠিত হয়েছে। ২০১৬ সালের আগেও এখানে হেফাজত এবং স্থানীয় একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী আন্দোলন সংগ্রামের নামে রেললাইন, রেলস্টেশন এবং কিছু স্থানে আক্রমণ করেছিল। সেই সময়ে এসব নিয়ে দেশে তীব্র প্রতিবাদ হয়। তবে অতীতের সকল আক্রমণের ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে এবার ২৬ ও ২৮ মার্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে তাণ্ডব, ধ্বংসলীলা, অগ্নিসংযোগ এবং নগরীর নানা স্থাপনার ওপর বর্বরোচিত আঘাত করা হয়েছে- সেটি এক কথায় নজিরবিহীন।

কেউ কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধ্বংসচিত্রকে ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডবের চাইতেও অধিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। সবচাইতে বেদনার বিষয় হলো, ধ্বংসলীলা যারা সংঘটিত করেছিল তারা হাতে অস্ত্র নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞকে পাহারা দিয়েছিল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা দমকল ও সাধারণ মানুষকে এসব অগ্নিকাণ্ড নেভাতে দেয়নি। বরং হুমকি দেয়া হয়েছিল কেউ যদি এক কদম এগোয় তাহলে তাদেরকে হত্যা করা হবে। যারা এমন মারমুখী ছিল তারা নিজেদেরকে হেফাজতে ইসলাম নামে পরিচয় দিচ্ছে। তারা দাবি করছেন যে তারা ইসলামের হেফাজত করছেন। শুধু তাই নয় তারা আরও দাবি করছেন যে, তাদের শাসন আমলে কোনো বেইনসাফ হবে না, সব মানুষের জীবন, সম্পদ সুরক্ষিত থাকবে। ইসলাম শান্তির ধর্ম তাই শান্তি প্রতিষ্ঠাই তাদের মূলমন্ত্র। এই কথাগুলো তারা প্রায়শই ধর্মীয় ওয়াজ, কিংবা বিভিন্ন আলোচনা, টিভি টকশোতে দাবি করে আসছেন। কিন্তু তাদের এই দাবির সঙ্গে কাজের মিল কতটা পাওয়া গেল সেটি বোধহয় যে কেউ মিলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। এটি অতীব সত্য কথা। সব ধর্মই মানুষকে শান্তির বাণী প্রচার করতে বলে। ইসলামও তাই করে আসছে। কিন্তু যে মানুষ দৈনন্দিন নানা ধরনের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকে, বিভিন্ন ধরনের সংগঠন কিংবা সংস্থার মধ্যে কাজ করে তারা কতখানি তাদের ধর্মের পবিত্র বাণী ধারণ ও চর্চা করার ক্ষেত্রে মনোযোগী থাকেন- সেটি একটি মৌলিক বিতর্কের বিষয়। খুব কম মানুষই মানবকল্যাণে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ধর্মের পবিত্র বাণীকে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে নজির স্থাপন করতে পেরেছেন- এটি ইতিহাস থেকে প্রমাণ নিলেই দেখা যাবে।

বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম সংগঠনটি ধর্মীয় সামাজিক সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার দাবি করলেও এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অনেকেই সংগঠনটিকে এমন সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করেছেন যা রাজনৈতিক সহিংসতা, ধ্বংসযজ্ঞসহ নানা ঘটনায় কখনও নেতৃত্ব দিয়েছে, কখনও ব্যবহৃত হয়েছে।

অন্য ঘটনাবলির উদাহরণ না টেনেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৬ এবং ২৮ মার্চ হেফাজতের নেতৃত্বে যেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ, তাণ্ডব, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর জবাব ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যবাদী যেকোনো ধর্মপ্রাণ মানুষকেও হতবাক করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

হেফাজতসহ কিছু রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বছর পালন উপলক্ষে ১৭ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনের যে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন কর্মসূচি পালন করছিল তাতে প্রতিবেশী ৫টি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ভিন্ন ভিন্ন দিনে অংশগ্রহণ নির্ধারিত ছিল। ২৬ মার্চ তারিখ ভারতের সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদী অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল এবং হেফাজতে ইসলাম বিরোধিতা করে। রাষ্ট্রাচারে সামান্য জ্ঞানগত ধারণা যাদের রয়েছে, তারা কোনো সরকারপ্রধানের এই ধরনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা নিয়ে তেমন কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানোর চিন্তা করার কথা নয়। তাছাড়া ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ভারতের জনগণ ও সরকার বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল, গঠিত অস্থায়ী সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করাসহ যাবতীয় কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে, মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিত্র বাহিনীর সদস্য হিসেবে ট্যাঙ্ক, কামান, বিমানসহ অংশগ্রহণ করেছিল। এতে ১৪ হাজার ৫০০-এর মতো ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ বিসজর্ন দিয়েছিলেন। ভারত আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও সহযোগিতা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেকারণেই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের পরাজিত করার মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র লাভ করতে পেরেছি। ভারতের এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে বাংলাদেশ কখনও অস্বীকার করতে চায়নি।

এবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তির রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ভারতের সরকারপ্রধানের উপস্থিতি ছাড়া অন্য ৪ জনের উপস্থিতি কতটা গৌরবের হতো সেটি যুক্তিবাদী যেকোনো মানুষের পক্ষেই বোঝার কথা কিন্তু আমাদের এখানে সেই যুক্তির ধার অনেকেই ধারছিলেন না। এমনকি বাম সংগঠনেরও অনেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর দলীয় পরিচয়কে তুলে ধরে তার আগমনকে সমালোচনা করছিলেন। তাদের রাষ্ট্রাচার সম্পর্কীয় জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। নরেন্দ্র মোদী বিজিপির দলীয় প্রধান নন, সরকারপ্রধান।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন সরকারপ্রধান হিসেবে। তাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী অন্য সরকারপ্রধানদের নিয়ে কিছু করার গুরত্ব কতখানি অর্জিত হতো সেটি বোঝার বিষয়। তাছাড়া ওইসব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক কতখানি। মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কতখানি তাও পরিমাপের বিষয়। অথচ আমাদের প্রধান বিরোধী দলসহ বিভিন্ন সংগঠন এবং হেফাজত অন্য কোনো দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের আগমন সম্পর্কে কোনো ধরনের বিরোধিতা করেনি।

ধরে নেই, বাংলাদেশের এই সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থেকে বিএনপি ক্ষমতায় যদি থাকত তাহলে তারা এ ধরনের অনুষ্ঠান আদৌ করত কিনা? যদি করত তাহলে ভারতের সরকারকে আমন্ত্রণ জানাত কিনা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সবার খোঁজা দরকার।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামও ২৬ মার্চে স্বাধীনতা দিবসে ভারতবিরোধিতার নানা স্লোগান নিয়ে মাঠে নামে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হাটহাজারী থানা, ভূমি অফিস আক্রমণ করে, খাগড়াছড়ি সড়কের মাঝখানের দেয়াল তুলে অবরোধ করে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঢাকাতেও হেফাজত, বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠন এবং আরও কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বায়তুল মোকাররম, শাপলা চত্বরসহ বেশ কটি জায়গায় সংঘাতে লিপ্ত হয়। সেই সংঘাত ব্যাপক কোনো রূপ ও ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারেনি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকায় বিরোধীরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা মিথ্যাচার ও অপপ্রচার শুরু করলে ফেসবুক শ্লথ করে দেয়া হয়।

২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বিরোধীদের বিরোধিতার কর্মকাণ্ড কতটা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল- সেটি মস্ত বড়ো প্রশ্নের উদ্রেক করে। ২৬ মার্চে ঢাকার বাইরেও আরও কয়েকটি জায়গায় এসব দল ও শক্তি কিছু শোডাউন করার চেষ্টা করে।

সবচেয়ে উগ্রবাদী আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজতের নেতাকর্মীরা রেলস্টেশনটি ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দেয়। রেললাইন বেশকিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও শহরে কয়েকটি জায়গায় হামলা সংগঠিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সময়সাপেক্ষের ব্যাপার। এ কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন থেকে কোনো যাত্রী এখন আর কোনো ট্রেনে উঠতে পারবে না, একইভাবে এই স্টেশন অতিক্রমকারী কোনো ট্রেন থামতেও পারবে না। ফলে সবচাইতে ভোগান্তি ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ মানুষ। তাদেরকে এখন অপেক্ষা করতে হবে কবে এই স্টেশনের ক্ষতিগ্রস্ত স্থপনাগুলো পুনর্নিমিত হবে?

২৬ তারিখের এতসব হামলা, ভাঙচুর, তাণ্ডব, হতাহত ইত্যাদি ঘটনার পর ২৮ তারিখ হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। বিএনপি হরতালের যৌক্তিকতা দেখিয়ে নৈতিক সমর্থন দেয়।

ভাসানী-সমর্থক ব্যানারে বামদের একটি অংশ এই হরতালকে সমর্থন করে। হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলাম আগে থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ২৮ তারিখে মাঠে নামে। গ্রামগঞ্জ থেকে তাদের সমর্থকদের লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাজির করা হয়। মসজিদের মাইক থেকে সবাইকে তাদের কর্মসূচিতে অংশ নিতে আহ্বান জানায়। ২৮ তারিখ দিনভর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে সবচাইতে নৃশংসতম ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। হামলাকারীরা ৭টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই মিলনায়তনের পাশেই অগ্নিনির্বাপক অফিস থেকে আগুন নিভানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু কর্মীদের অগ্রসর হতে বাধা দেয়া হয় হেফাজতের নেতাকর্মীর পক্ষ থেকে। হুমকি দেয়া দেয়া হয় তাদেরকে মেরে ফেলার, গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার। হেফাজতের কাছে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও পেট্রোল ছিল যা ভবন পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে জেলার সমস্ত মানুষের ভূমি-সংক্রান্ত দলিলপত্র ধ্বংস হয়েছে। এর ভোগান্তি পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। ভবিষ্যতে জমি-সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হতে পারে। জেলা প্রেসক্লাবে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর আগুন জ্বালানো এবং সাংবাদিকদের ওপর আঘাত হানা হয়েছে। বেসরকারি ৩টি কলেজের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে। উন্নয়ন মেলার ৩০টিরও বেশি দোকানে ভাঙচুর করা হয়েছে, অতর্কিতে ট্রেনের ওপর হামলা করা হয়। ১ পুলিশ সদস্য, ২ সাংবাদিকসহ ৩৪ জন মানুষ তাদের আক্রমণে আহত হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছাড়াও আশুগঞ্জ ও সরাইল উপজেলায়ও হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে এতে সরাইলে দুজন নিহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয়, তাতে ৫০টিরও অধিক স্থাপনার বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এভাবে প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্রসহ হামলা করার নজির কোনো রাজনৈতিক দলের নেই, পবিত্র ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করে যারা করেছেন তারা এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হরতালের দিন হেফাজতে ইসলাম তাণ্ডব চালানোর মতো প্রস্তুতি প্রকাশ্যেই নিয়েছিলো। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করেনি তা বোধগোম্য নয়। সরকারের বিভিন্ন বাহিনী যদি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করত তাহলে হেফাজতের নেতাকর্মীরা কতখানি সাহস দেখাত সেটি দেখার বিষয় হতো। রাষ্ট্রের সেই দায়িত্ব রয়েছে, কোনো সংগঠন এভাবে তাণ্ডব করার অধিকার রাখে না।

২৮ তারিখের পর আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরেজমিনে দেখে আসে। কয়েকজন সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক প্রতিনিধিও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘটিত তাণ্ডব দেখে এসেছেন। কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর প্রধান সাংবাদিক সম্মেলন সেখানে করেছেন, তার কন্ঠে আমরা দৃঢ়তা পাইনি। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তদন্ত শেষে অপরাধীদের ধরা হবে, বিচারের আওতায় আনা হবে। যা বলেছেন, প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই আমরা অনুরূপ শুনে থাকি। তবে এসব তদন্ত কবে শেষ হবে সেটি মস্ত বড়ো প্রশ্ন।

২০১৬ সালের তদন্ত প্রতিবেদন এখনও প্রকাশিত হয়নি। সেকারণেই প্রশ্ন উঠেছে বর্তমান তদন্তের গতি-প্রকৃতি কী হবে, উদ্দেশ্য কতটা অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার সহায়ক হবে- সেটি দেখার বিষয়।

যদি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই তাণ্ডবের আইনানুগ বিচার না হয়, অপরাধীরা বিচারের আওতায় না আসে তাহলে হেফাজত নিকট ভবিষ্যতে দেশব্যাপী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চাইতেও বেশি তাণ্ডব চালাতে সাহস পাবে। বিশেষত যারা সরকার উৎখাতের গোপন ষড়যন্ত্র করছে, তারা হেফাজতকে নিয়ে নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলতে সাহস পাবে। সুতরাং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজত যারা নষ্ট করেছে তারা গোটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিজেদের এবং অন্যদের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। সরকার কী করবে, কী করা উচিত তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ওঠা এখনই জরুরি।

লেখক: অধ্যাপক-গবেষক, সমাজচিন্তক

শেয়ার করুন