স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিবশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ২৬ মার্চ হেফাজতের নায়েবে আমীর মাওলানা সাজিদুর রহমান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক মোবারক উল্লাহর নির্দেশনায় হেফাজতিরা প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে হামলা করে পুরো স্টেশনটি পুড়িয়ে ছাই করার দুঃসহ স্মৃতি প্রতিদিন আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই হেফাজতিরা এমনটি ২০১৬ সালেও করেছিল কিন্তু এই অপকর্মে জন্য তাদেরকে আইনের আওতায় আসতে হয়নি! কেন আসতে হয়নি, সেটি এখনও অস্পষ্টই থেকে আছে। আর সেজন্যই হয়তো আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে তারা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে আক্রমণ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিল এবং একই সঙ্গে শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা বঙ্গবন্ধুর সব ম্যুরাল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক উদ্বোধনকৃত সব নামফলক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিনষ্ট করার মতো দৃষ্টতা দেখিয়েছিল।
এছাড়াও ২৬ মার্চ এই হেফাজতিরা বীরদর্পে পৌরসভা, এসপি অফিস, ২ নং পুলিশ ফাঁড়ি, জেলা মৎস্য কর্মকর্তার অফিস, সিভিল সার্জন অফিস, সার্কিট হাউসের গাড়ি, জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর ডিজিএফআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার মোটরসাইকেলের ওপর আক্রমণ করে। তারা হামলা চালায় জেলা জজ, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বাসভবনে। এই বাসভবনগুলোর সামনেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের জেলা স্মৃতিসৌধ, যেখানে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সর্বস্তরের জনগণ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রু হেফাজতিরা সেই স্মৃতিসৌধে রাখা সকল পুষ্পস্তবক পায়ে মাড়িয়ে তছনছ করে দেয় যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় সরাসারি আঘাত। এই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা কেবল রাষ্ট্রদোহীদের পক্ষেই করা সম্ভব । কিন্তু এত কিছুর পরও সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ নীরব! তাদের এই ভূমিকায় আমাদেরকে সেদিন হতবাক করেছে। সেদিন আওয়ামী লীগ কিংবা তাদের সহযোগী কোনো সংগঠনও মাঠে ছিল না। এক কথায় বলতে গেলে ২৬ মার্চের বিকেলটি ছিল হেফাজতের দখলে এবং শহরজুড়ে উড়ছিল হেফাজতিদের দেওয়া বিভিন্ন স্থাপনায় প্রতিরোধহীন আগুনের ভয়ানক লেলিহান!
পরের দিন (২৭ মার্চ) বিকেলে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও শেখ হাসিনার নামফলক ও শহরজুড়ে ব্যাপক তাণ্ডবের প্রতিবাদে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বের হয় একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল। এটাতে সরকার কী অন্যায় দেখেছে, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। তবে আমরা মনে করি, জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ মিছিলটি যৌক্তিক ছিল। কেননা বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর আঘাত আসলে জনগণের দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ করা নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এই ঠুনকো অজুহাতে ২৮ তারিখ হেফাজতিদের ভয়াবহ তাণ্ডবকে রাষ্ট্রযন্ত্র তো পারেই না, এমনকি কোনো সভ্য সমাজও সমর্থন করতে পারেন না। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৮ মার্চ হরতালের দিন হেফাজতিরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদের উপর যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল সেখানের স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎসাহ দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। কেননা এই তাণ্ডব প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন সেদিন চাইলে ১৪৪ ধারা জারি করতে পারতেন, কিন্তু তারা সেটি করেননি। যখন ভূমি অফিস, পৌরসভা, ওস্তাদ আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা পুড়ছিল তখন সেই আগুন নেভাতে ফায়ারসার্ভিসের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি! এমনকি বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের কাছে সাহায্য চাওয়ার পরও তারা এগিয়ে আসেনি। তারা ওপরের অর্ডার না পাওয়ায় আগুন নেভাতে আপারগতা প্রকাশ করে!
২৮ মার্চ সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় ছিল- এই হেফাজতিরা যখন থানার দিকে ঢিল ছুড়ছিল তখন সদর থানা থেকে মাইকে ঘোষণা করছিল, ‘বিক্ষোভকারী ভাইয়েরা আপনারা আমাদের ওপর ঢিল ছুঁড়বেন না, আমরা আপনাদের সাথে আছি’! এই ঘোষণা শোনার পরপরই হেফাজতি সন্ত্রাসী ও তাদের দোসরেরা সারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব সরকারি স্থাপনা জ্বালিয়ে দেয়। স্থানীয় প্রশাসনের এরকম অপেশাদিরত্ব ও দায়িত্বহীন আচরণ শুধু হতাশাজনকই নয়, একইসঙ্গে রহস্যজনকও বটে। এই তাণ্ডব প্রতিরোধের ব্যর্থতার দায়ভার কোনোভাবেই স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী এড়াতে পারেন না। পাশাপাশি আমরা মনে করি এই কর্মকাণ্ডের সাথে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র লুকায়িত। কাজেই আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী চাই, এই নারকীয় তাণ্ডবের একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত করে ঘটনার মূল রহস্য এবং প্রকৃত দোষীদের আইনে আওতায় আনা হোক।
পাশাপাশি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমাদের কিছু প্রশ্ন হলো- ২৬ মার্চে যখন হেফাজতিরা রেলস্টেশন পুড়িয়ে দিচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও প্রধানমন্ত্রীর নামফলকসমূহ ভাঙচুরসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল তখন আপনার প্রশাসন কেন কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়েনি? এসব ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৭ মার্চ যে প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়েছিল, সেটিকে তো আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী যৌক্তিক মনে করি কিন্তু এই মিছিলটি বের করাকে আপনার কাছে কেন অযৌক্তিক মনে হল? আমাদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে আপনি এবং আপনার প্রশাসন কেন ব্যর্থ হল? ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আপনি অরক্ষিত রেখেছেন? ২৮ তারিখ স্থানীয় সংসদ সদস্য আপনাকে ফোন করে আপনার সাহায়্য চাওয়ার পরও কেন আপনি তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসলেন না? কেন আপনার দমকল বাহিনী আগুন নিভানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না? আপনার দমকল বাহিনীর কাছে সাহায্য চাওয়ার পর তারা বলেছে ওপরের অর্ডার না থাকায় আগুন নেভাতে পারবে না, আমরা জানতে চাই এই ওপরের অর্ডারটা কে দিয়েছিল? আমাদের এই শহরে এতো বড় একটা ধ্বংসযজ্ঞ ঘটার পরও কেন আপনি একবারের জন্যও এখানে পরিদর্শনে এলেন না? ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেসব হেফাজতি নেতাদের নেতৃত্বে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, বিশেষ করে সাজিদুর রহমান ও মোবারক উল্লাহরা কেন এই ঘটনার ২৭ দিন পরেও গ্রেফতার হয়নি? ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদে হেফাজতিরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, সেই ঘটনার বিচার আজ পর্যন্ত কেন হয়নি? মাননীয় মন্ত্রী দয়া করে এসব প্রশ্নের একটু ব্যাখ্যা দিবেন কী?
আরও পড়ুন >> ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব: অবিলম্বে পালের গোদাদের গ্রেপ্তার করুন
লেখক: সিনিয়র সাব-এডিটর, মত ও পথ এবং সাবেক ছাত্রনেতা।