সহিংসতার মামলা: তালিকায় ২১ জেলার প্রায় ২০০ হেফাজত নেতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব। ফাইল ছবি

সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় অভিযান শুরুর আগে পুলিশ হেফাজতে ইসলামের ৩০ জনের একটি তালিকা করলেও নতুন করে প্রায় ২০০ জনের নামের তালিকা করা হয়েছে। এতে রাজধানী ঢাকাসহ ২১ জেলার নেতা-কর্মীর নাম রয়েছে। এর মধ্যে হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও রয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ সূত্র বলছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রতিক সহিংসতায় সংগঠনটির যেসব নেতা-কর্মী সক্রিয় ছিলেন বা উসকানি দিয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ওয়াজ মাহফিল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেন এমন কিছু হেফাজত নেতা ও ব্যক্তির নামও রয়েছে।

universel cardiac hospital

তালিকায় থাকা হেফাজতের শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতাদের অনেকে একই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক অন্যান্য দলের সঙ্গেও যুক্ত। এর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, ২০ দলভুক্ত খেলাফত মজলিস এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও তালিকায় আছেন।

সর্বশেষ গতকাল শনিবার গ্রেপ্তার হয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আহমেদ আবদুল কাদের। তিনি ২০-দলীয় জোটভুক্ত খেলাফত মজলিসেরও মহাসচিব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে হেফাজতকর্মীদের দেয়া আগুন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে হেফাজতকর্মীদের দেয়া আগুন। ছবি : সংগৃহীত

কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি এই তালিকা সংশ্লিষ্ট জেলায় পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত অন্য নেতাদের নাম সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে দুটো পন্থায় কাজ করা হচ্ছে। প্রথমত নামগুলো সংশ্লিষ্ট জেলায় পাঠিয়ে তাদের নাম-ঠিকানা যাচাই করে গ্রেপ্তার করতে বলা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রভাবশালী কেউ হয়ে থাকলে সে ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে টিম পাঠিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তারে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তালিকার মধ্যে থাকা নেতা-কর্মীদের ৬৮ জনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তালিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের ৩৯ জন করে ৭৮ জন।

এছাড়া ঢাকার আছেন ২০ জন, কক্সবাজারের ২৭ জন, ফরিদপুরের ১১ জন ও নারায়ণগঞ্জের আছেন ৭ জন। এর বাইরে সিলেট, হবিগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ফেনী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খুলনা, বগুড়া, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী ও সুনামগঞ্জের নেতা-কর্মীর রয়েছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা হয়। ২৬ মার্চ জুমার নামাজের পর ঢাকার বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষের জের ধরে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মাদ্রাসার ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিল থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে এবং থানাসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা হয়। সেখানে গুলিতে চারজন মারা যান।

এর জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষোভে নামেন মাদ্রাসার ছাত্ররা। সেখানে রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। এরপর ২৭ ও ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক সহিংসতা ও সরকারি স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটে। সেখানে তিন দিনে গুলিতে প্রাণ হারান সরকারি হিসাবে ১৩ জন, আর হেফাজতের দাবি ১৫ জন।

ওই তিন দিনের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭৭টি মামলার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এসব মামলায় আসামি ৪৯ হাজারের বেশি। সহিংসতার পর হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সরকার মূলত ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ব্যাপক সহিংসতার বিষয়টি আমলে নিয়ে হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ৩ এপ্রিল হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক দ্বিতীয় স্ত্রীসহ নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে অবরুদ্ধ হওয়া, তারপর সেখানে হেফাজতের কর্মীদের হামলা ও মামুনুল হককে ছিনিয়ে নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় গতি পায়। এরপর ১১ এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার ডিবি পুলিশ। তাঁকে ২০১৩ সালের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এরপর থেকে প্রতিদিনই হেফাজত নেতাদের গ্রেপ্তারের খবর আসতে থাকে। ১৯ এপ্রিল মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর সংগঠনটির বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থানের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। গতকাল পর্যন্ত হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকার ১৯ জন নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে মামুনুল হকের ঘনিষ্ঠ এমন কয়েকজন নেতা ও ওয়াজের বক্তা গ্রেপ্তার হয়েছেন। তালিকায় মামুনুলের ঘনিষ্ঠ আরও কয়েকজন সম্ভাব্য গ্রেপ্তার হওয়ার তালিকায় আছেন।

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজত নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদে সাম্প্রতিক সহিংসতায় যেসব ব্যক্তির নাম আসছে, তাঁদের নাম তালিকাবদ্ধ করেছেন। এরপর সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশকে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কেন্দ্রীয়ভাবে পুলিশের করা তালিকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাঁদের নাম রয়েছে তাঁদের মধ্যে ১৯ জন মাদ্রাসার শিক্ষক। হেফাজতের পদধারী নেতা আছেন ছয়জন। অন্যরা কর্মী-সমর্থক। গতকাল পর্যন্ত সেখানে ৩৫৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে তাঁদের মধ্যে হেফাজতের নেতৃস্থানীয় বা তালিকায় নাম থাকা কেউ নেই। এর মধ্যে গত শুক্রবার হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুফতি আবদুর রহিম কাসেমী সংগঠন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি সহিংসতার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনারও দাবি জানিয়েছেন। যদিও পুলিশের তালিকায় তাঁর নামও ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

পুলিশের তালিকায় হেফাজতের আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর নামও রয়েছে। রয়েছে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ বিভিন্ন এলাকার বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার নাম। তবে বাবুনগরীকে শিগগির গ্রেপ্তার করা হবে কি না, এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি।

তবে এই তালিকায় হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলামের নাম নেই। তিনি গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাসমূহের’ জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ ক্ষেত্রে হেফাজতের নেতাদের আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিল। ভবিষ্যতে হেফাজতের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী এসব ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকবেন।

বিবৃতিতে হেফাজতের মহাসচিব ‘গণগ্রেপ্তার’ বন্ধের দাবি জানান। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও উসকানি দেওয়ার পেছনে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবেন বলেও জানান।

শেয়ার করুন