ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নারকীয় তাণ্ডবের ঘটনার জন্য শুরু থেকেই হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করে আসছেন পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। হেফাজতের সহিংসতায় ঘটনায় ৫৬টি মামলায় রোববার পর্যন্ত ৩৭৫ জনকে গ্রেফতার করেছে বলে পুলিশ। এর মধ্যে হেফাজতের পদধারী কেবল তিনজন নেতা রয়েছেন।
গতকাল সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতার এক মাস পূর্ণ হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের হিসাবে, এ পর্যন্ত যে ৩৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বিএনপির ৩৫ জন, জামায়াত-শিবিরের ৩ জন ও ৩৩৭ জন হেফাজতের কর্মী-সমর্থক রয়েছেন।
তবে স্থানীয় হেফাজতের ভাষ্য, তাদের ‘১০-১৫ জন মাওলানাকে’ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে গত রোববার রাতে জেলা হেফাজতের সহকারী প্রচার সম্পাদক মুফতি জাকারিয়া খানকে (৪৩) ও সোমবার রাতে সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের হেফাজতের ছাত্র ওলামা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ক্বারী মো. মোজাম্মেল হক ও আশুগঞ্জ উপজেলা হেফাজত ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুফতি উবায়দুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়।
আর জেলা বিএনপির ভাষ্য, বিএনপির নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ ৫৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাহলে বাকি প্রায় ৩০০ জন কারা—এ প্রশ্নই এখন সামনে এসেছে। এ বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি গ্রেফতার হওয়া ২৮ জনের পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। সহিংসতার ঘটনায় মামলা দায়েরের পর বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ওই ব্যক্তিদের স্বজনদের ভাষ্যমতে, তাঁরা কেউ চা বিক্রেতা, শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, নিরাপত্তাকর্মী, ট্রাকচালক, জুতার কারখানার শ্রমিক, এমনকি চারবার স্ট্রোক করা রোগীও গ্রেফতার হয়েছেন। ওই সহিংসতায় আসাদুল্লাহ রাতিন (১৬) এবং কামাল মিয়া (৩১) দুই ব্যক্তি গুলিতে নিহত হওয়ার পর তাঁদের নাম উল্লেখ করে মামলার আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এঁরা সবাই ‘আমজনতা’।
যাঁদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন জেলা শহরের দাতিয়ারার রায়হান খান (২৪), শিমরাইলকান্দি এলাকার বাকের মিয়া (১৯), পাওয়ার হাউস রোডের নুরুল হক (৩৫), সদর উপজেলার ঘাটুরার মনির হোসেন খন্দকার (৩৪) ও তাঁর ভাই কামরুজ্জামান খন্দকার (২৪), ওবায়দুল্লাহ (২৫), আতিকুল খন্দকার (২৬), মামুন খন্দকার (২৫), ফরহাদ হাজারী (২৮) ও তাঁর ভাই উবায়দুল হাজারী (১৭), সাদেকপুরের উবায়েদ আহমেদ (২৫), বিরাসারের দ্বীন ইসলাম (২৬), সুজন মিয়া (২২), রবিন মিয়া (১৮) ও শামীম মিয়া (৩৫), সুহিলপুরের ফারুক মিয়া (২২), ফরহাদ মিয়া (৩১), শামীম মিয়া (২০), আজিজুল হক (৩০), শরীফ মিয়া (২৫), খোকা মিয়া (১৬), মো. শাওন (২২), ফারুক মিয়া (২০), গোলাপ হাজারী (৩৬), জাহিদ হাসান (২০), হাসনাত খন্দকার (৩০), নন্দনপুরের মাঞ্জু মিয়া (৪১) ও সরাইল বিশ্বরোড মোড়ের আজিজুল হক (২৪)। এঁদের মধ্যে সাতজনের বাড়িতে সরেজমিনে এবং বাকিদের পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। পরিবারের লোকজনের দাবি, তাঁরা কেউই হেফাজতের কর্মী বা সমর্থক নন। সাতজনের এলাকার লোকজনও বলেছেন, গ্রেফতার ওই ব্যক্তিরা হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত নন।
জেলার পুলিশ সুপার মহাম্মদ আনিসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁরা হেফাজতের কার্যক্রম ও হরতালে অংশ নিয়েছেন। ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতায় তাঁরা অংশ নিয়েছেন। পদধারী নেতাদের এখনো গ্রেফতার করা হয়নি, এমন বিষয়ে তিনি বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখেই আসামিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আসামিরা বিভিন্ন জায়গায় পালিয়েছেন। তাঁদের ধরতে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। শনিবার দিবাগত রাতে মসজিদের দুজন ইমামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হেফাজতের হরতালের দিন মাইকে তাঁরা গুজব ছড়িয়েছেন। এখনে আপনারা তাঁদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা হয়তো অস্বীকার করবেন। কিন্তু মাইকে গুজব ছড়ানোর ফুটেজ রয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার ঘটনায় ৫৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সদর থানায় ৪৯টি, আশুগঞ্জ থানায় ৪টি, সরাইল থানায় ২টি ও আখাউড়া রেলওয়ে থানায় ১টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ৪১৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা প্রায় ৩৯ হাজার জনকে আসামি করা হয়।
সদর উপজেলার বিরাসার এলাকার বাসিন্দা সুজন মিয়া, রবিন মিয়া ও শামীম মিয়াকে জেলা শহরের কুমারশীল মোড়ের ফলের দোকান থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁরা তিনজনই ফলের দোকান করেন। সুজনের ভগ্নিপতি কাওসার মিয়া ও রবিনের মা লুবনা বেগমের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা জানান, হেফাজতের হরতালের দিন তাঁরা ফলের দোকান খোলা রেখেছিলেন। ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। পুলিশ তাঁদের হেফাজতের কর্মী হিসেবে গ্রেপ্তারে করেছে। কিন্তু তাঁরা কখনোই হেফাজতের কর্মী বা সমর্থক—কোনোটাই নন।
ঘাটুরা এলাকার আতিকুল খন্দকারকে গত ২৬ মার্চ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হামলা ও মামুন খন্দকারকে গত ২৮ মার্চ হেফাজতের হরতালের সময় পৌরসভায় হামলার মামলায় হেফাজতের কর্মী হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়।
কথা হয় আতিকুল খন্দকারের মা নূরজাহান বেগম ও মামুন খন্দকারের মা মর্জিনা বেগমের সঙ্গে। তাঁরা জানান, আতিকুল ট্যাংকলরির চালক। আর মামুন বেকারির মালামাল আনা-নেওয়া করেন। নূরজাহান ও মর্জিনা দুজনেরই দাবি, তাঁদের এলাকার খোকন খন্দকার পুলিশের সোর্স। কয়েক দিন আগে তাঁদের সঙ্গে খোকনের ঝগড়া হয়েছিল। এ কারণে খোকন তাঁদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা জানান, তাঁদের বাড়িরই বাসিন্দা বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিক বিল্লাল খন্দকার (২৭) ও দুলাল খন্দকারকেও (৪৫) সহিংসতার ঘটনায় আসামি করা হয়েছে। এঁরা কেউ হেফাজতের কর্মী নন।
জেলা শহরের পাওয়ার হাউস রোড এলাকার নুরুল হককে হেফাজতের কর্মী হিসেবে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁর স্ত্রী রুমি হক বলেন, নুরুলের চারবার স্ট্রোক হয়েছে, বাইপাস সার্জারিও হয়েছে। রোগের কারণে নুরুল সব সময় হইচই, গ্যাঞ্জাম এড়িয়ে চলতেন। রুমি বলেন, ১৩ এপ্রিল রাতে ডিবি পুলিশ বাসা ভাড়ার কথা বলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নুরুল হককে গ্রেফতার করে। তিনি কোনো দল করেন না, হেফাজতের সমর্থকও নন।
গ্রেফতার শরীফ মিয়ার বাবা মাহতাব মিয়া ছেলের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, শরীফ কাঁচামালের ব্যবসা করেন। গত ২৭ মার্চ দুপুরে সবজির টাকা সংগ্রহ করতে বুধল গিয়েছিলেন। নন্দনপুর বাজারে ঝগড়ার কথা শুনে বিকেলে গ্রামের ভেতর দিয়ে বাড়ি চলে আসে। তিনি বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ করি, অন্য কোনো দল করি না। হেফাজত তো প্রশ্নই আসে না।
গ্রেফতার হওয়া সেলুনকর্মী খোকা মিয়ার বাবা বাহরাইনপ্রবাসী জাকির হোসেন করোনায় দেশে এসে আটকা পড়েছেন। এর মধ্যেই ছেলে সহিংসতার মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। জাকির হোসেন বলেন, ২৭ মার্চ বিকেলে সুহিলপুর বাজারে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের খবর শুনে তিনি ছেলের সেলুনে গিয়ে দোকান বন্ধ করে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি আসেন। পরদিন (২৮ মার্চ) হেফাজতের হরতালের সময়ও খোকা মিয়া সেলুন খুলে কাজ করেছে। বিকেলে বাড়ি এসে রোজগার করা ৫০০ টাকাও বাড়িতে দিয়েছে। খোকার বয়স ১৬ বছর পূর্ণ হয়নি বলে দাবি তাঁর।
বুধল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য শহীদ মিয়ার ছোট ভাই মাঞ্জু মিয়াকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শহীদ মিয়ার দাবি, তাঁর ছোট ভাই জাতীয় পার্টি করেন। কিন্তু গ্রেফতার করে তাঁকে হেফাজতের কর্মী হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ফরহাদ হাজারী (২৮) ও ওবায়দুল হাজারীর (১৭) বাবা তবদুল হোসেন বলেন, ফরহাদ অ্যাম্বুলেন্স চালাতেন। আর ওবায়দুল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী ছাত্র পরিষদের’ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। তাঁদের হেফাজতের কর্মী-সমর্থক হিসেবে গ্রেফতার করেছে। তাঁরা তো হেফাজতের কর্মী-সমর্থক নন।
কাছম আলী খন্দকারের দুই ছেলে মনির হোসেন খন্দকার ও কামরুজ্জামান খন্দকারও গ্রেফতার হয়েছেন। কামরুজ্জামান ট্রাক চালান আর মনির দুই নম্বর গ্যাস ফিল্ডের সামনের পেট্রোলপাম্প–সংলগ্ন জুতা ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। কাছম আলী বলেন, কামরুজ্জামান হরতালের দিন ট্রাকে বালু আনতে হবিগঞ্জের সাতছড়িতে গিয়েছিলেন আর মনির জুতার ফ্যাক্টরিতেই ছিলেন। এরপরও পুলিশ তাঁদের হেফাজত হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে। তাঁরা কেউই হেফাজতের কর্মী বা সমর্থক নন।
গ্রেফতার হওয়া ফারুকের চাচা কামাল মিয়া, গোলাপ হাজারীর স্বজন গোলাম রব্বানী, শামীমের বাবা মো. জালাল, ফরহাদের স্বজন, জাহিদ হাসানের বাবা সহিদ মিয়ার সঙ্গে কথা হয় আমাদের প্রতিনিধির। তাঁদের সবার দাবি, তাঁদের স্বজনেরা কেউ হেফাজতের কর্মী নন, তাঁরা সহিংসতার সঙ্গেও যুক্ত নন।
সরাইল বিশ্বরোড মোড়ের আজিজুল হকের বাবা নাজমুল হক বলেন, বিশ্বরোড মোড়ের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন আজিজ। ঘটনার সময় ব্যাংক খোলা ছিল, আজিজ ব্যাংকেই ছিলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জজ আদালতের আইনজীবী আলাউদ্দিন মুন্সী বলেন, পুলিশ সহিংসতার ঘটনায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী-সমর্থককে গ্রেফতার করেছে। বাকি যাঁদের পুলিশ হেফাজতের কর্মী-সমর্থক বলছে, তাঁদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষকে গণহারে গ্রেফতারের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বুঝতে হবে। এই গ্রেফতার, এই মামলার কোনো ফলাফল নেই। ফলাফল শূন্য।
নেতাদের ভাষ্য
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জেলা হেফাজতের শীর্ষনেতাদের পাওয়া যায়নি। হেফাজতে ইসলামের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা সাজিদুর রহমান এবং জেলা হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক ও জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মুবারকুল্লাহর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। শহরের কান্দিপাড়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসায় গিয়েও তাঁদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হেফাজতের কর্মী মাওলানা আবদুল হকের সঙ্গে গ্রেফতারের বিষয় নিয়ে কথা হয়। হেফাজতের বিভিন্ন মিছিলে সম্মুখসারিতেই ছিলেন আবদুল হক। তিনি প্রথমে বলেন, আমাদের ১০ থেকে ১৫ মাওলানাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁরা হেফাজতের কর্মী।তাহলে বাকি গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা কারা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ তো আর নিশ্চিত না হয়ে কাউকে গ্রেফতার করছে না। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের লোকজনও গ্রেফতার হয়েছেন। কর্মীদের বাইরে হেফাজতকে মনে মনে সমর্থন করেন, এ রকম আরও অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি তাঁর।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বলেন, আমাদের কথা স্পষ্ট, সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক। তবে এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কাউকে গ্রেফতারের তথ্য আমাদের কাছে নেই।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হাফিজুর রহমান মোল্লা বলেন, আমাদের ৫৯ জন নেতা–কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গেই হেফাজতের সুসম্পর্ক ছিল। হেফাজত তাদেরই লোক। সবকিছু করল তারা, আর এখন ভুগছেন আমাদের নেতা–কর্মীরা।