খুঁটি দেওয়া, বৃত্তবন্দী সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত বৃত্তেও অনেক ফাঁক, ফোকড়, ফাঁকি

নাঈমুল ইসলাম খান
নাঈমুল ইসলাম খান

বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মালিক ওই সংবাদমাধ্যমের গলায় বেঁধে যতটুকু দীর্ঘ দড়ি খুঁটি দিয়ে নির্ধারণ করে দেন, স্বাধীনতার সীমানা ততোটুকুই। গরুর গলায় দড়িটা দেখা যায়, সংবাদ মাধ্যমের দড়িটা অদৃশ্য। এইটুকুই পার্থক্য।

মালিকের বেঁধে দেওয়া ওই সীমানার ভেতর আরও আছে বিজ্ঞাপনদাতার প্রভাবে স্বাধীনতাহীন/পরাধীন কিছু ছিটমহল। (ঘুনে খাওয়া অদৃশ্য/ অস্পষ্ট অঞ্চল)।

universel cardiac hospital

তারপরে আরও আছে দলীয় আনুগত্যে সাংবাদিক সমাজের বিভক্তির কারণে সৃষ্ট আরও কিছু অসহায়, প্রতিনিধিত্বহীন ছিটমহল।

রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক আইন-কানুনের ভয়ে সেলফ-সেন্সরশিপে মিডিয়া কাভারেজ থেকে আড়ালে থাকা ‘ছিটমহল’ রয়েছে আরও কিছু। (অনেক ফাঁক ফোকড়)।

সংবাদপত্রের সামর্থ্যরে অভাবে, সূত্রের অভাবে, সাংবাদিকের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার অভাবে অথবা বিভিন্ন পক্ষের দাপটের ভয়ে মিডিয়া কিছুই করে না, তাকায়ওনা এমন উপেক্ষিত ক্ষেত্র বা ছিটমহলতো রয়েছেই। (কী দুর্ভাগা এই বাংলাদেশ)।

এতোকিছুর পরেও এই দেশে অনেক মিডিয়াকে অনেক সময় নিরুৎসাহিত ও নিস্ক্রিয় করে রাখা সম্ভব হলেও কোনো না কোনো সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম প্রায় প্রতিটি অন্যায় অনিয়ম উন্মোচন করে বলেই আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি। কখনো হয়তো ক্ষীণ বা মুষ্টিমেয় মিডিয়ায় সেটা প্রকাশ হয়, কিন্তু হয়।

বর্তমান সামাজিক মাধ্যমের দাপটপূর্ণ এই সময়ে শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মূল ধারার সংবাদপত্র যদি কখনও কোনো কিছু চেপে যায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কারও রক্ষা হয় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেটা প্রকাশিত হয়। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে বা আমি বলবো সোশ্যাল মিডিয়ার অজুহাত দেখিয়ে হলেও মূলধারার মিডিয়া, একটু দেরিতে হলেও, হয়তো একটু কম কিন্তু বিষয়টা কাভার করতে শেষ পর্যন্ত সচেষ্ট হয়ই।

একটি সংবাদপত্রে সঙ্গে কারও সম্পর্ক যতো গভীর এবং নিবিড় সেই সংবাদপত্রে তার কোনো অপকর্মের খবর ছাপা হওয়ার সম্ভাবনা ততই কম।

কোনো পত্রিকার সাথে কারও সম্পর্ক যদি কোনো কারণে বৈরি বা শত্রুতার হয় তার যেকোনো ভুল ত্রুটি অন্যায়ের ব্যাপারে সেই পত্রিকায় অব্যাহতভাবে বিধ্বংসী প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন হবে। এই সংবাদপত্রের সাথে সহমর্মী অন্য কিছু সংবাদ মাধ্যমও এই রকমেরই খবর/ বিশ্লেষণ প্রকাশ হবে।

কোনো সংবাদপত্রের সাথে পরিচয় নেই এমনকি যাকে কেউ মোটেই চেনে না এমন মানুষের অনেক অন্যায় বা অপরাধের ব্যাপারে অনেকে খোঁজই পাবে না। প্রতিবেদন করার তো প্রশ্নই আসে না।

কারও যদি সমাজে সাধারণভাবে ইতিবাচক ইমেজ থাকে এবং হঠাৎ কোনো অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন এমন ক্ষেত্রে সংবাদিকতা হবে নিয়মিত অথবা স্ট্যান্ডার্ড প্রসেস এবং প্রসিডিউরে।

অনেক মানুষ থাকেন যাদের সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচুর বন্ধু থাকেন, শুভানুধ্যায়ী থাকেন, তাদের ব্যাপারে যদি কোনো অনিয়ম অন্যায় খবর তৈরি হয়, এই খবরও আতুর ঘরেই হত্যা করা হয়ে থাকে। সংবাদপত্রে সংবাদপত্রে কিছু ঘনিষ্ঠতার গ্রুপিং থাকে, উপদল থাকে। এক দলের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের প্রতিকূলে যায়, তেমন কোনো কিছু ওই গ্রুপের কোনো সংবাদপত্রই প্রকাশ করে না।

আমরা যখন নাগরিকের জানার অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করি, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বহুল আলোচিত হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন জাগে কেউ কি একটু খাটাখাটনি করে, তথ্যানুসন্ধান করে দেখবেন আমাদের সংবাদপত্র সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ এবং সম্পর্কের খাতিরে প্রতিদিন যতো খবর নিজেরাই হত্যা বা ব্ল্যাক আউট করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জন্য সে তুলনায় কত শতাংশ বিঘ্ন তৈরি হয়?

সব আলোচনা সমালোচনা শেষে সাংবাদিকতার শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, প্রতিটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের যার যার নিজস্ব বিচ্যুতির কারণে কোনো কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝে ব্যর্থতা দেখাবে কিন্তু সকল প্রতিষ্ঠান সব সময়, সব বিষয়ে ব্যর্থ হয় না, এখানেই আমাদের শেষ ভরসা। আমাদের সংবাদমাধ্যম যতোবার আমাদের হতাশ করে, তার চেয়ে বেশি আমাদের সন্তুষ্ট করে। এটুকু মানতেই হবে।

বসুন্ধরা গ্রুপের সংবাদ মাধ্যমগুলো সরাসরি তাদের মালিকের বিরুদ্ধে এই মামলার খবর প্রকাশ না করাটা বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে কোনো নতুন বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা মোটেই না। বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়িক মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম তাদের মালিক প্রতিষ্ঠান বা তাদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে আনিত, উত্থাপিত খবর সাধারণত প্রকাশ করে না। তাই বর্তমান ঘটনায় আমাদের নতুন করে অতিরিক্ত হতাশ হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। এটা দীর্ঘদিনের দুঃখজনক সূত্র। এই সংবাদপত্রগুলো অন্তত: দেশ রূপান্তর বা সময়ের আলোর মতো নির্মম, নিষ্ঠুর অপরাধ করেনি।

শেয়ার করুন