নাটকের শেষ অঙ্ক দেখার অপেক্ষা

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)। ফাইল ছবি

সিনেমার দৃশ্যে প্রথম দিকে ভিলেনের দৌরাত্ম্য দেখা গেলেও চূড়ান্ত দৃশ্যে তার চরম পরাজয় ঘটে। বিনোদনের জন্য সিনেমায় অনেক রংচং ও বাড়াবাড়ি থাকে। কিন্তু ভালো সিনেমায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব চিত্রই ফুটিয়ে তোলা হয়। ভালো-মন্দ, উত্থান-পতন, ফেরেশতা-শয়তান, আলো-অন্ধকার, সৎ-অসৎ সব কিছুতেই পরস্পর বিপরীতমুখী রঙ্গমঞ্চকে ঘিরে পৃথিবী চলছে, ঘুরপাক খাচ্ছে। মানবসভ্যতার অগ্রগতির জন্য এই বিপরীতমুখিতার আবশ্যকতা রয়েছে। তবে দেবতা আর অসুরের যুদ্ধে শেষতক অসুরের পরাজয় ঘটলেও পথিমধ্যে সংঘটিত রক্তপাত আর নিদারুণ ট্র্যাজেডির ভার ভুক্তভোগী মানুষের পক্ষে সব সময় বহন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্তব্ধ হয়ে পড়ে মনুষ্যত্ব ও মানবতা। তাই দানব, অসুর, শয়তান ও ভিলেনদের যত তাড়াতাড়ি থামানো যায়, তত ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।

একবার ভেবে দেখুন, পবিত্র ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে একাত্তরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কী অধর্মই না করেছে, আর তাদের সহযোগী হয়েছে হেফাজতের মতো এ দেশীয় এক শ্রেণির লেবাসধারী মুসলমান, তখন তাদের নাম ছিল জামায়াত, আলবদর, রাজাকার, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ইত্যাদি। পবিত্র ধর্মকে কিভাবে তারা চরম অবমাননা এবং অপবিত্র করেছে তার সব কিছুই এখন দালিলিকভাবে প্রমাণিত। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এসে সেই জামায়াত, নেজামে ইসলাম, আলবদর, রাজাকার, মুসলিম লীগ—এদের নতুন বংশধররা কেউ আজ পুরনো নামে, কেউ বা নতুন নামে একই পন্থায় রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধর্মের নামে অধর্মের সব সীমালঙ্ঘন করে চলেছে।

universel cardiac hospital

এদেরই এক পক্ষ নতুন পরিচয়ে হেফাজতে ইসলাম, অর্থাৎ ইসলাম রক্ষাকারী নাম ধারণ করে বিগত কয়েক বছর মানবতাবিরোধী ও রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজ করে চলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উড্ডয়ন না করা কি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ নয়। ১৯৭৫ সালের পর পর্যায়ক্রমে দুই সামরিক শাসক ক্ষমতায় বসে ১৫টি বছর রাষ্ট্র ও রাজনীতির যে মহাসর্বনাশ করেছেন, তার সূত্রে বাংলাদেশের সমগ্র রাজনীতি আজ পতিত, কলুষিত, বিভাজিত এবং চরম আদর্শগত পদস্খলনের শিকার হয়েছে বলেই তার সুযোগ নিচ্ছে ওই ধর্মীয় লেবাসধারী গোষ্ঠী। উদাহরণ হেফাজতে ইসলাম। একটার পর একটা অপরাধ করে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। ভিলেনের দৌরাত্ম্যে মানুষ আজ অতিষ্ঠ। নামটাই প্রতারণামূলক। মানুষকে ধোঁকা দেওয়া। ভাই, আমরা তো রাজনীতি করছি না, আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা চাই না, আমরা ইসলাম রক্ষা করতে চাই। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও একই কথা বলেছে, ক্ষমতা নয়, আমরা ইসলাম রক্ষা করার জন্য সব কিছু করছি। একাত্তরের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংলাপ শুরুর প্রাক্কালে ইয়াহিয়া খান হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম রক্ষা করি।’ (হুসেন হাক্কানি, পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি-পৃ. ৭৫)

বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষার জন্য ২০১০ সালে আবির্ভূত হয়ে মাঠে নেমেছে হেফাজতে ইসলাম। কেউ কি একটা তালিকা করে দেখাতে পারবেন এত বছরে বাংলাদেশে ইসলামের কী কী ক্ষতি হয়েছে। অথচ পরিসংখ্যান রয়েছে, সত্তর-একাত্তরে বাংলাদেশে যতসংখ্যক মসজিদ-মাদরাসা ছিল তার থেকে এখন সেটা পাঁচ-ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আনুপাতিক হিসাবে এবং তুলনামূলকভাবে সাধারণ শিক্ষা থেকে ধর্মীয় শিক্ষায় সরকারের বাজেট সব সময় অনেক বেশি থেকেছে। ইসলাম ধর্মের রাষ্ট্রীয় পরিচর্চার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামের বিশাল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তাহলে ইসলাম রক্ষাকারী একটি দলের কি প্রয়োজন পড়ল, আর তারা কেনই বা জাতীয় পতাকা পোড়াচ্ছে, জাতির পিতার ম্যুরাল ভাঙছে এবং জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করছে। এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই হেফাজতের আসল উদ্দেশ্য নিহিত আছে। সৌদি আরবসহ বিশ্বের সব মুসলিমপ্রধান দেশের সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ।

হেফাজত মুখে বলছে তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। অথচ দেখুন, ২০২০ সালে জুনাইদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে যে কেন্দ্রীয় কমিটি তারা করেছে তাতে ৩১ জন ছিল জমিয়তুল উলামা ইসলাম দলের নেতা, ২৩ জন খেলাফত মজলিসের, চারজন ইসলামী ঐক্যজোটের, পাঁচজন খেলাফত আন্দোলন, পাঁচজন জামায়াত ইত্যাদি। এই দলগুলো আবার ২০ দলীয় ঐক্যজোটের প্ল্যাটফর্মে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ। হেফাজতের বড় নেতা মামুনুল হক খেলাফত মজলিসের মহাসচিব, তাঁর পিতা ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মাওলানা আজিজুল হক, একাত্তরে পাকিস্তানের সহযোগী। সুতরাং অরাজনৈতিক বলে এত দিন তাঁরা মানুষকে পরিষ্কার ধোঁকা দিয়ে আসছেন। এই ধোঁকাবাজি কি ইসলামসম্মত। এই কাজ যাঁরা করেছেন তাঁদের কি আলেম-উলামা বলা যায়। এসব মানুষের কাছে ধরা পড়ার পর ধোঁকা দেওয়ার নতুন কৌশলে বাবুনগরী পুরনো কমিটি ভেঙে দিয়ে এখন বলছেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের কমিটিতে রাখা হবে না।

হেফাজতের ধোঁকাবাজি এবং তার আড়ালে তাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ছিল। ওই সময় ২০ দলীয় জোট গঠিত হয় এবং তাতে আজকের হেফাজতের সঙ্গে থাকা নেতারা তাঁদের নিজ নিজ দল নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হন। তাঁরা যদি সত্যিই হেফাজতের ১৩ দফা বৈশিষ্ট্যের এবং ভাস্কর্যহীন বাংলাদেশ চান, তাহলে ওই সময়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা নিয়ে সংবিধান সংশোধন করার দাবি তাঁরা তুললেন না কেন? তখন তো এই নেতারা এ সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি।

আসল কথা হলো, অতি ধূর্ত এসব লেবাসধারী ভালো করে জানেন, এই ধরনের পশ্চাৎপদ অন্ধকারে পূর্ণ ১৩ দফাসংবলিত তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর উদ্যোগ যে সরকারই নিক, পার্লামেন্টে তাদের যতই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকুক, বাংলাদেশের জনগণ, নতুন প্রজন্ম স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠবে, ওই সরকারকে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করে ছাড়বে। সুপ্ত ভলকানো একবার জ্বলে উঠলে তার থাবা থেকে যেমন কিছুই রক্ষা পায় না, তেমনই হতো যদি জামায়াত-বিএনপি সরকার এই উদ্যোগ নিত। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই দাবি উত্থাপনের পেছনে বজ্জাতি কারণ রয়েছে। তারা ভালো করে জানে এসব দাবি মেনে নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে, নিরীহ অবুঝ মাদরাসাছাত্রদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে প্রচণ্ড নাশকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে যদি সরকারকে আপসে আনা যায়, তাহলে সেই সুযোগে নিজেদের শক্তি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করে একসময়ে সেই অর্জিত শক্তি দিয়েই আওয়ামী লীগ সরকারকে ঘায়েল করা যাবে। আর সরকার যদি আপস না করে, তাহলে ইসলাম রক্ষার নামে সারা দেশে জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সরকারকে অস্থিতিশীল রাখা, যাতে তার সব কিছু আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায়।

২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনকে টার্গেট করেই তারা পরিকল্পিতভাবে এসব করছে। কারণ তারা ভালো করে জানে, বর্তমান সরকার রাষ্ট্রের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনার পথে যেভাবে এগোচ্ছে, তা যদি আরো সাত-আট বছর অব্যাহত থাকে, তাহলে ১৯৭৫ সালের পর আবির্ভূত জামায়াত, হেফাজত, বিএনপি এবং এই সম্মিলিত গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আর থাকবে না। দুনিয়ায় বিশাল সম্ভাবনার সব কিছু সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে অবুঝ মাদরাসাছাত্রদের মানবঢাল হিসেবে হেফাজত যেভাবে ব্যবহার করছে, সেটি রীতিমতো মানবতাবিরোধ অপরাধ। এই ছাত্রদের মামুনুল হকের মতো শিক্ষকরা সবক দেন, এই দুনিয়া কিছু না, দুনিয়ায় কিছু চাওয়া-পাওয়ার নয়, বরং ইসলাম রক্ষার নামে জীবন দিলে পরকালে সব কিছু পাওয়া যাবে। অথচ এই মামুনুল হক বৈধ-অবৈধ তিনজন নারীর সঙ্গে বসবাস করেন। ঢাকার মতো ব্যয়বহুল শহরে তিনটি পরিবারের খরচ বহন করেন। ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা, আর বিশাল বহর গাড়ি। এগুলোকে ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, নাকি অন্য কিছু বলবেন।

২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে কয়েক হাজার মাদরাসায় পড়া অবুঝ ছাত্রদের মানবঢাল হিসেবে বসিয়ে দেয় এবং মঞ্চে উঠে হেফাজত নেতারা হুংকার ছাড়েন, ১৩ দফা মানতে হবে, নইলে এই রাতেই সরকারকে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করা হবে। উল্লসিত হয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতারা মঞ্চে উঠে হেফাজতকে সমর্থন দেন। জামায়াতসহ অন্য ইসলামিস্ট দলগুলোয় হেফাজতের অংশ। ঢাকার আনাচে-কানাচে খবর ছড়িয়ে পড়ে আগামীকাল নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন বাবুনগরী, সঙ্গে থাকছে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যরা। তার পরও বলে, আমরা অরাজনৈতিক সংগঠন। প্রতারণার সব সীমা তারা লঙ্ঘন করেছে। সীমালঙ্ঘনকারীকে স্বয়ং আল্লাহও পছন্দ করেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি ও রাজনৈতিক সাহসের কাছে সেদিন ওই সম্মিলিত গোষ্ঠী পরাজিত হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৫ মে একটি কলঙ্কিত দিন হয়ে থাকবে। সারা দেশ ওয়াজের বক্তা কারা হবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা একটা সংগঠন করা হয়েছে। বক্তারা ধর্মের আড়ালে কী কী রাজনৈতিক বক্তৃতা দেবেন তার জন্য সমন্বয় করা হয় হেফাজতের পক্ষ থেকে। ওয়াজ মাহফিলে তাঁরা বলেন, তালেবানের আফগানিস্তান হলো শ্রেষ্ঠ দেশ, আর মোল্লা ওমর শ্রেষ্ঠতম নেতা। বিশ্বের সব মানুষ জানে, তালেবান আর মোল্লা ওমর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সৃষ্টি। হেফাজত আইএসআইয়ের সৃষ্টি। তাই হেফাজত আর তালেবান দুই ভাই, একে অপরের প্রশংসা করবে সেটাই স্বাভাবিক। মূলকথা, কখনো বিএনপি, কখনো জামায়াত, কখনো হেফাজত, আবার কখনো এদের সম্মিলিত শক্তির দ্বারা পেছন থেকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে অথবা ক্ষমতা থেকে উত্খাত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যার সর্বশেষ সংস্করণ হেফাজত এবং তাদের তাণ্ডব। কিন্তু লেখার সূচনাতে যে অমোঘ নীতির কথা বলেছি, তার সূত্রেই বলি, এসব প্রতারক, বকধার্মিক অশুভ শক্তি সাময়িক সংকট সৃষ্টি করতে পারে, তাতে রক্তপাতও ঘটবে হয়তো, উন্নয়নের গতি শ্লথ হবে। কিন্তু শেষ বিচারে শুভশক্তির প্রতীক বাঙালি সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের জয় হবে। সিনেমার প্রথম দিকে ভিলেনের দৌরাত্ম্যে মানুষ যেমন কিছুটা ভয় পায়, তেমনি হেফাজত কিছুটা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পেরেছে। কিন্তু কথায় আছে, দশ দিন চোরের একদিন গৃহস্থের। হেফাজত আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছে ধরা পড়ে গেছে। দর্শক এখন নাটকের শেষ অঙ্ক দেখার অপেক্ষায় আছে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com

শেয়ার করুন