কওমী মাদ্রাসা ও রাষ্ট্রের করণীয়: ড. নদভীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মতামত

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

০৩ মে ২০২১ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় আমার সহকর্মী চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী সাহেবের কওমী মাদ্রাসা সম্পর্কিত একটি লেখা আমার দৃষ্টিতে এসেছে। আমি মনোযোগের সাথে তাঁর লেখাটি পাঠ করেছি। তিনি বহু ধারা উপধারায় বিভক্ত মুসলিম সমাজের একটি ধারা ভারতের দেওবন্দ নামক স্থানের সুখ্যাত কওমী মাদ্রাসার অনুসারীদের বা অনুকরণকারীদের আদলে গঠিত বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে তাঁর সুচিন্তিত মতামত তুলে ধরেছেন। জনাব নদভীর রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে আমি অবহিত। তারপরও বলব যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও ছাত্রদের কর্মকান্ডে সুস্থ চিন্তার, ইতিবাচক অগ্রসর চিন্তার মানুষের মতোই তিনিও বেশ উৎকন্ঠিত বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। জনাব নদভীর আলোচনা থেকে আমাদের কওমী (অর্থ জাতীয়), আলিয়া মাদ্রাসার বিপরীত ইসলামী ধারার শিক্ষা) মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের মাঝে কিছুটা শুভ বুদ্ধির উদয় হয়, তাহলে আমরা শতকরা ১০ ভাগ হলেও আশ্বস্ত হতে পারি।

কিন্তু বাস্তব সমস্যাটা অন্যত্র। জনাব নদভীর চোখ কিভাবে তা এড়িয়ে গেল (সেই সাথে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল স্তরের কর্তাব্যক্তিবর্গ ও জনগণের) তা আমার বোধগম্য হয় নাই। (বলে রাখা ভাল যে, আমি ব্যক্তিগতভাবে বহু ধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে একমূখী শিক্ষাব্যবস্থা তথা ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে প্রতিষ্ঠাযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষপাতি)। স্বাধীনতার পর পরই কওমী মাদ্রাসা সমূহ কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশের কয়েকটি বড় বড় মাদ্রাসায় কওমী শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে একেবারেই পাকিস্তান আমলের আদলে। তারা তাদের মাদ্রাসা সমূহে পাঠদানের মাধ্যম হিসাবে উর্দুকেই গ্রহণ করে এবং তা আজও অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ মন-মানসিকতার দিক থেকে তারা পাকিস্তানী ভাবধারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সারা দুনিয়ার, সেই সাথে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যান্য ধারার সময়ে সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসলেও কওমীরা সেই মান্ধাতার আমলে সিলেবাস নিয়েই পড়ে রয়েছে। কোনই মৌলিক পরিবর্তন সেখানে পরিদৃষ্ট নয়।

universel cardiac hospital

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের কর্ণধার সরকার এবং অন্যান্য ক্ষমতাবান গোষ্ঠিসমূহ যা কখনই নিজেদের ভাবনায় আনেনি, তা হচ্ছে (১) কওমীরা আদৌ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কিনা? (২) তারা বাংলাদেশের সংবিধান মানে কিনা? (৩) তারা জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকা মানে কিনা? (৪) কওমীরা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন করে কিনা? (৫) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ওরা জাতির পিতা হিসেবে মানে কিনা? (৬) মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের অনুমোদনের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় আনতে তারা সম্মত কিনা? (বাংলাদেশের সর্বত্র যেভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো কওমী মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে- এমনকি, একই বিল্ডিং এ একাধিক মাদ্রাসা, তা সত্যিই আশংকাজনক এবং সবগুলিই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত এবং এদের শিক্ষার মান নির্ণয়ের কোন পদ্ধতি আছে কিনা, তা জানা নেই কারও)? (৭) বড় বড় মাদ্রাসা গুলোর প্রায় শতভাগ শিক্ষক-ছাত্র তাদের বাইরে কাউকে মুসলমান মনে করে কিনা, সন্দেহ আছে। (৮) বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা বিকাশের বিরুদ্ধে তারা সর্বদাই খড়গহস্ত (৯) তারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহিদ দিবস মানে কিনা? (১০) তারা তাদের সিলেবাস আধুনিকায়ন করতে প্রস্তুত কিনা?

উল্লেখিত বিষয় গুলো নিয়ে আমরা কখনও মাথা ঘামাইনি। অথচ আমাদের উচিত ছিল মাথা ঘামানো। এবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিবশতবর্ষ প্রতিপালন উপলক্ষে সারা দেশের কর্মকান্ড আর কওমীদের কর্মকান্ডের বৈপরিত্যই শুধু নয়, তাদের দেশদ্রোহী মনোভাবেরও পরিচয় জাতি জানতে পেরেছে। তারা ইসলামের প্রাথমিক যুগের খারিজিদের মতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেয়। মাদ্রাসাগুলোতে লাঠিসোটা ও অস্ত্রাদি মজুদ রাখে এবং অকারণে লাঠিসোটা, তলোয়ার ও অন্যান্য ভোতা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমে আসে। আল্লাহ পবিত্র কোরানে যে ফেৎনা-ফেসাদের কথা নিষেধ করেছেন, সেই ফেৎনা-ফেসাদই হচ্ছে তাদের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কার বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করে? তারা কি সরকারের বিরুদ্ধে, তারা কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করে? বিষয়টা স্পষ্টকরণ প্রয়োজন।

স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, স্বাধীনতা ও বিজয়দিবস, শহিদ দিবস ইত্যাদি প্রশ্নে কওমীদের অবস্থান সম্পর্কে রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণকে পরিষ্কার ধারণা পেতে হবে। জেহাদ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার হতে হবে। ইসলাম ধর্মের অন্যান্য ধারা-উপধারা সম্পর্কে তাদের অবস্থান পরিষ্কার হতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ধর্ম, ব্যক্তি ও গোষ্ঠি বিশেষের নিজস্ব বিষয়। এখানে অন্যের উপর নিজস্ব ভাবধারা চাপিয়ে দেয়ার জন্য লাঠিয়াল বাহিনীর আশ্রয় নেয়ার কোন সুযোগ বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের সবকিছু পরিচালিত হবে সংবিধান, আইন ও স্বাশতঃ বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য অনুসারে। ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কোনও সুযোগ এখানে নেই। কওমীসহ ধর্মাশ্রয়ী সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে এটি বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাবনা সুস্পষ্ট ও নিম্মরূপঃ

১) একটি শক্তিশালী জাতীয় কমিশন গঠন করে – যার প্রধান হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি, যেখানে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য আলেম ও বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক, সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিগণও থাকবেন। (২) কওমী মাদ্রাসার সিলেবাস বিন্যাসের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যারা বিজ্ঞান ভিত্তিক একটি ধর্মীয় ভাবনার সিলেবাস তৈরি করতে সক্ষম, তাদেরকে গঠিত কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। (৩) মাদ্রাসা স্থাপনে কেন্দ্রীয় কওমী শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন অত্যাবশ্যক করা প্রয়োজন। (৪) মাদ্রাসাগুলোকে অস্ত্রবাজির আওতামুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক।

আমাদের ধারণা, আমাদের বক্তব্য ও প্রস্তাবনার আলোকে যদি রাষ্ট্র ও সরকার কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে, তবে দেশের মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় সহিংসতা ও উম্মদনা পরিহার করা সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে, দেওবন্দীয় কওমী ধারা ইসলামী চিন্তাভাবনার একটি উপধারা মাত্র। ইসলামী চিন্তা ভাবনার আরও বহু ধারা-উপধারা রয়েছে। (প্রসঙ্গতঃ ড. নদভী তাঁর আলোচনার এক জায়গায় আমিরুল মুমেনিনের কথা উল্লেখ করেছেন, তা বিষয়টা কী ? তিনি কি এ বিষয়ে খোলামেলা কিছু বলবেন ?)। এসব কিছু মাথায় রেখে আমাদেকে পরবর্তী কর্মধারা প্রনয়ন করতে হবে।

লেখক: সংসদ সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা,
সম্পাদক, মত ও পথ।

শেয়ার করুন