মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে শুক্রবার (১৪ মে) বার্নি স্যান্ডার্সের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ নিবন্ধে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যের ইহুদি ধর্মাবলম্বী ও বামপন্থী এই সিনেটর। সেই নিবন্ধটির অনুবাদ মত ও পথের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
‘ইসরায়েলের নিজেকে রক্ষা করার অধিকার আছে’
এই শব্দগুলো আমরা ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান উভয় প্রশাসনের কাছ থেকেই শুনি যখন ইসরায়েলের সরকার তাদের প্রকাণ্ড সামরিক শক্তি নিয়ে গাজার রকেট হামলার জবাব দেয়।
চলুন একটি বিষয়ে পরিষ্কার হই। কেউ এটা নিয়ে তর্ক করছে না যে ইসরায়েল, অথবা যে কোনো দেশের সরকারের নিজেকে রক্ষা করার অথবা তার জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার অধিকার রয়েছে। তাহলে কেন এই শব্দগুলো বছরের পর বছর, যুদ্ধের পর যুদ্ধ ধরে বারবার বলা হচ্ছে? এবং কেন এই প্রশ্নটি প্রায় কখনোই করা হয়না : ‘ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারগুলো কী?’
এবং কেন শুধু ইসরায়েলের ওপর রকেট পড়ার সময়েই আমরা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সহিংসতার বিষয়টিতে নজর দেই?
এই সঙ্কটের মুহূর্তে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানানো। এটাও আমাদের বোধগম্য যে, হামাস ইসরায়েলি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে যে রকেট ছুড়ছে তা অগ্রহণযোগ্য। আজকের সংঘর্ষ এসব রকেটের কারণে শুরু হয়নি।
জেরুজালেমের শেখ জাররাহতে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো বহু বছর ধরে উচ্ছেদ হওয়ার ভয় নিয়ে বসবাস করছে, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার সুবিধার্থে তৈরি একটি আইনী ব্যবস্থার মধ্যে তাদের রাখা হয়েছে। এবং গত কয়েক সপ্তাহে, উগ্রপন্থী বসতি স্থাপনকারীরা (সেটলার) তাদের উচ্ছেদ করার প্রচেষ্টা আরও তীব্র করেছে।
এবং, দুঃখজনকভাবে, এসব উদ্ধেদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিস্তৃত ব্যবস্থার মাত্র একটি দিক। বহু বছর ধরে আমরা পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি দখল আরও গভীর হতে এবং গাজায় অবরোধ চলতে দেখেছি যা ফিলিস্তিনিদের জীবন ভীষণরকম অসহনীয় করে তুলেছে। গাজার জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশই বেকার, তাদের ভবিষ্যত প্রায় অন্ধকার।
তদুপরি, আমরা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকারকে ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের কোণঠাসা করতে, তাদেরকে ভয়ঙ্কর হিসেবে তুলে ধরতে, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের সম্ভাবনা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে বসতি স্থাপনের নীতি বাস্তবায়ন করতে এবং ইসরায়েলের ইহুদি ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মধ্যে পদ্ধতিগতভাবে বৈষম্য বাড়ানোর লক্ষ্যে আইন পাস করতে দেখেছি।
এসবের কোনো কিছুই হামাসের হামলাকে- যা মূলত জেরুজালেমের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে নিজেদের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের একটি প্রয়াস, অথবা ফিলিস্তিনের দূর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর প্রশাসনের ব্যর্থতাকে বৈধতা দেয়না- যারা সম্প্রতি দীর্ঘ দিনের স্থগিত একটি নির্বাচনকে আবার স্থগিত করেছে। কিন্তু এ বিষয়ের বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েলের একক কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে, এবং শান্তি ও ন্যায়বিচারের পরিবর্তে তারা বৈষম্যমূলক ও অগণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চলেছে।
ইসরায়েলে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ডানপন্থী শাসনে জনাব নেতানিয়াহু একটি প্রবল অসহিষ্ণু ও কর্তৃত্ববাদের বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। দূর্নীতির মামলা এড়িয়ে যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার চরম প্রচেষ্টার মাধ্যমে জনাব নেতানিয়াহু এসব কর্তৃত্বকে বৈধতা দিয়েছেন, যার মধ্যে ইতামার বেন গভির ও তার উগ্রবাদী ‘ইহুদি শক্তি’ দলকে সরকারে অন্তর্ভূক্তকরণও রয়েছে। এটা হতবাক হওয়ার মতো এবং দুঃখজনক ঘটনা যে, যেসব বর্ণবাদী জনতা জেরুজালেমের রাস্তায় ফিলিস্তিনের ওপর হামলা করে তাদের এখন নেসেটেও (ইসরায়েলের আইনসভা) প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
এই বিপজ্জনক চর্চা শুধু ইসরায়েলেই হচ্ছে না। সারা বিশ্ব জুড়েই- ইউরোপ, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এখানে যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা একইরকম কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান দেখেছি। এ ধরণের আন্দোলন অনেক মানুষের সমৃদ্ধি, ন্যায়বিচার ও শান্তির বদলে কিছু দূর্নীতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষমতা হাসিলের জন্য জাতিগত ও বর্ণবাদী ঘৃণাকে কাজে লাগায়। এসব আন্দোলনের এক মিত্র বিগত চার বছর হোয়াইট হাউসের ভেতরে ছিলেন।
একই সঙ্গে, আমরা অ্যাক্টিভিস্টদের একটি নতুন প্রজন্মও লক্ষ্য করছি যারা মানবিক প্রয়োজন ও রাজনৈতিক সাম্যতার ভিত্তিতে সমাজ গড়তে চায়। গত গ্রীষ্মে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকে কেন্দ্র করে আমরা আমেরিকার রাস্তায় এসব অ্যাক্টিভিস্টদের দেখেছি। আমরা তাদের ইসরায়েলে দেখেছি। আমরা তাদের ফিলিস্তিনের অঞ্চলগুলোতে দেখেছি।
নতুন প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের এখন বিশ্বের প্রতি নতুন এক পন্থা গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে- যার ভিত্তি হবে ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র। হতে পারে এটা দরিদ্র দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দিয়ে সহায়তা করছে বা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে অথবা বিশ্ব জুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। সংঘর্ষ নয়, বরং সহযোগিতার প্রচারণার মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে, যেখানে আমরা ইসরায়েলকে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি ডলার সাহায্য দেই, সেখানে নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকার এবং তার অগণতান্ত্রিক ও বর্ণবাদী আচরণকে আমরা আর সমর্থন দিয়ে যেতে পারি না। আমাদের অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ পন্থা ধারণ করতে হবে, যা নাগরিক সুরক্ষার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আইনের পাশাপাশি ‘যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্যের আইন অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘনে সক্ষম হবে না’- এই বিষয়টিকে সমর্থন ও শক্তিশালী করবে।
এই পন্থায় অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে যে ইসরায়েলের শান্তিতে ও নিরাপদভাবে থাকার অধিকার রয়েছে, কিন্তু এই অধিকার রয়েছে ফিলিস্তিনিদেরও। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনের জন্য সেই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি মানবাধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠস্বর হতে চায়, তাহলে আমাদের অবশ্যই মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানগুলো নিয়মিতভাবে ধরে রাখতে হবে, এমনকি যখন তা রাজনৈতিকভাবে কঠিন হবে তখনও। আমাদের অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে যে ফিলিস্তিনিদের অধিকার গুরুত্বপূর্ণ, ফিলিস্তিনিদের জীবন গুরুত্বপূর্ণ।