কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও তার কবিতা

আহমেদ মাওলা

হাবীবুল্লাহ সিরাজী
হাবীবুল্লাহ সিরাজী। ফাইল ছবি

মৃত্যুই অনিবার্য সত্য, পৃথিবীর সব প্রাণীই মৃত্যুর অধী। তবু এমন এক দুঃসময়ে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী চলে গেলেন যে, তার অসংখ্য ভক্ত-শুভার্থী শেষ বিদায়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেল না। এই আপসোস সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকের কাছে করুণ বেদনার ইতিহাস হয়ে থাকবে।

ষাটের দশকের শেষদিকে কবি হিসেবে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর অবির্ভাব। তার কবি-মানস গড়ে উঠেছে মূলত সময়তাড়িত শৈল্পিক যন্ত্রণায়। কবিতাকে তিনি মনে করেন প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের অনুষঙ্গ ও ব্যক্তিগত ভাবনার অকপট প্রকাশ। তার কবিতায় আছে নিম্নবর্গেও মানুষের জীবন, প্রকৃতি ও প্রেম। সমকালীন রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতির অবভাসধর্মী চেতনাকে ধারণ করলেও কোনো নির্দিষ্ট দল বা মতের দাসত্ব থেকে মুক্ত। বরং শৈল্পিক ও মানবিক প্রতীতি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতাকে দিয়েছে প্রয়োজনীয় গৌরব।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী (জন্ম: ১৯৪৮, ৩১ ডিসেম্বও; মৃত্যু: ২৫ মে, ২০২১) মৃদুকণ্ঠের কিন্তু গভীরতা ব্যাপ্ত কবি। তার কবিতায় বহিঃস্থ বাস্তবতার চেয়ে অন্তর্লোকই বেশি প্রতিফলিত। এই অন্তর্লোক তার কবি-সত্তার অবিরাম উৎসারণ। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর এই আত্মতা ও ব্যক্তিকতাই তাকে স্বাতন্ত্র্যের সিংহদ্বারে পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের মনে পড়ে যায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম- দাও বৃক্ষ দাও দিন (১৯৭৫)। ‘বৃক্ষ’ এবং ‘দিন’-এর প্রত্যাশা ও প্রার্থনার মধ্যে তার অন্তর্লোক প্রতিফলিত। তার কবিতার শব্দশরীরে উৎকীর্ণ থাকে ধ্বনি, স্থানবৈশিষ্ট্য এবং অন্তঃশীল স্মৃতিলোক- যা সমূহ বাস্তবতাকে রূপান্তরিত করে বর্ণময় গভীরতায়। বহিশ্চাপ ও অন্তঃবেদনা বাঙালি কবিরা বহন করে আসছে সুদূর অতীতকাল থেকে। নারী আর পুরুষ-আধার ও আধেয়কে দেখা হয়েছে আত্মা এবং চৈতন্য হিসেবে। তাই বাংলা কবিতায় নারী দেহবাচক প্রত্যয়-প্রতিমায় গঠিত। ব্যক্তি-কবি শব্দে-ছন্দে-অলংকারে পুরুষ-আত্মাকে গড়ে তুলেছে চৈতন্য হিসেবে।

আত্মা অর্থাৎ অর্থের পরিসর থাকে অমূর্তলোকে অসীম। সাংকেতিক ও সংবেদনার জগত। মূলত শব্দই কবিতার আত্মার প্রতিভূ। বাংলা কবিতার শব্দ তাই ভাবমূলক,বস্তু-অতিরেক অর্থদ্যোতক এবং নৈশঃব্দ্যের মাত্রায় উত্তীর্ণ এক বৈভব। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতায় শব্দ তাই ভাবমূলক, বস্তু অতিরেক অর্থদ্যোক, নৈঃশব্দের শব্দ মাত্রায় উন্নীত-

‘জলপাই সোমবার বছরে কদাচিৎ আসে
ছেলে-বুড়ো সেদিন স্বাস্থ্য পায়, যৌবন পায়
ফলন্ত বৃক্ষের মতো নতজানু হয় অহংকার
তামাটে মানুষের বুকে ঘটে নীরব উৎসব
মোরগের ঝুটির মতো ভালোবাসার পতাকা উড়িয়ে
জলপাই সোমবার যায় এবং আসে
একজন কেবল একবারই পায় জলপাই সোমবার।’
(জলপাই সোমবার/শ্রেষ্ঠ কবিতা)

নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে বাঙালি মিশ্র-সংকরায়িত জনগোষ্ঠি। দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, আর্য, মঙ্গলয়েট, ককেশিয় সিমেটিক, ইংরেজ এসব নরগোষ্ঠির স্বভাব,আবেগ প্রবণতাটিও ধারণ করেছে বাঙালি। বাঙালির জীবনধারায় আধ্যাত্মিকতায়, মননশীলতায় এবং সৃষ্টিশীলতাও আবেগই মুখ্য নিয়ন্ত্রক। বঙ্গ-সমতট, নদীবৃক্ষ পরিবেষ্টিত নিসর্গজগত, পরিপার্শ্ব প্রগাঢ়ভাবে ছায়া ফেলেছে তার চিন্তায়, অভিজ্ঞতায় ও জীবনায়নে। যেমন-

‘উকুন মগজ খায়, ঘাতকের নল খায় নিঃশ্বাসের ধ্বনি
হানাদার মাংস খায়, শব্দ-সুর মেধা খায় পা-চাটা কুকুর
হায়নারা রক্ত খায়, দাঁতে-চোখে মোহাম্মদী বেগ
হাতের অপর পিঠে অন্য হাত, আরেক মীরন
সিরাজ কেবল মরে,বিশ্বসের পদচিহ্ন মুছে যায় বারুদের তাপে
সে আসন শূন্য থাকে,তারা থাকে রক্ত কণিকায়।’
(সৌধ/শ্রেষ্ঠ কবিতা)

স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং তারপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পালাবদল উঠে এসেছে এখানে। যেন মীরজাফরের বংশধরেরা সিরাজের মতোই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে উল্লাসে মেতে ওঠে। ‘মীরনের পদচিহ্ন’ যেন বিশ্বাসঘাতকের রক্তকণিকায়। সিরাজের আসন শূন্যই থেকে যায় যেমন, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও সেই আসন শূন্য পড়ে থাকে। এই শূন্যতা পূরণ হবার নয়। হাবীবুল্লাহ সিরাজী এভাবে মৃদুকণ্ঠে অথচ গভীরভাবে সংবেদনাটি সঞ্চারিত করে দেন কবিতায়। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে, আত্মজীজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হন তিনি। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতাকে বিষয়, ভাষা ও প্রকরণগত দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-

এক. দাও বৃক্ষ দাও দিন (১৯৭৫), মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি (১৯৭৭), মধ্য রাতে দুলে ওঠে গ্লাস (১৯৮১), হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি (১৯৮২), নোনাজলে বুনো সংসার (১৯৮৩)।

দুই. স্বপ্নহীনতার পক্ষে (১৯৮৪), আমার একজনই বন্ধু (১৯৮৭), পোষাক বদলের পালা (১৯৮৮), কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯০), সিংহ দরজা (১৯৯০), বেদনার চল্লিশ আঙুল (১৯৯০)।

তিন: ম্লান ম্রিয়মাণ নয় (১৯৯২), বিপ্লব বসত করে ঘরে (১৯৯৯), ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ন (১৯৯৯), জয় বাংলা বল রে ভাই (২০০০), সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না (২০০০), সুগন্ধ ময়ূর লো (২০০০), মুখোমুখি (২০০১), কতো আছে জলছত্র কতো আছে চেরাপুঞ্জি (২০০৬)।

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর প্রথম দিকের কবিতায় ছিলেন একান্ত ব্যক্তিক, আত্মমর্মর। আপন ব্যক্তিকতায় তিনি ছিলেন সলজ্জ, অবগুণ্ঠিত। এ পর্বে তার কবিতার উৎসভূমি ছিল হৃদয়। তাই কবিতাগুলোতে আত্মতা ও ব্যক্তিকতা প্রধান হয়ে উঠেছে। আপন ভাবনা-কল্পনা-স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়-

কুয়াশা চুমুকে দিন খ’সে গেলে পথে
ঋারি বসন্ত শাদা পালে খোঁজে ঘুম
আবলুস ঘন মেহগনি ঝরা পাতা
করাঘাত করে চোখ জোড়া শার্সিতে
প্রেম ব’সেছিলো উঁচু বেঞ্চিতে একা।
(অবশিষ্ট উন্মোচন/শ্রেষ্ঠ কবিতা)

শব্দ এখানে কেবল শব্দ নয়, আবেগ ও কল্পনার বিচ্ছুরণ, হৃদয়-উৎস থেকে উৎসারিত। ‘কুযাশা’, ‘চুমুক’, ‘মেহগনির ঝরাপাতা’- এসব অনুষঙ্গের মধ্যে ‘প্রেম’ একা বসে থাকে বেঞ্চিতে। বোঝা যায় ব্যক্তিকতায় কতটা নিমর্জ্জিত কবি।

‘স্বপ্নহীনতার পক্ষে’ এবং ‘আমার একজনই বন্ধু’ কাব্যেও শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট কবি ব্যক্তিকতা থেকে বেরিয়ে আসছেন। তার ভ্রমণ এবং বিচরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবিধ গলির দিকে। প্রকৃতি ও নিসর্গেও পাশাপাশি সমকালীন সমাজের চাপ ও তাপ তাঁকে দগ্ধ করছে। পোষাক বদলের পালা এবং বেদনার চল্লিশ আঙুল গ্রন্থের শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক নেতাদের দলবদল যেন পোশাক বদলের মতোই হয়ে উঠেছে। বিদ্রুপের কষাঘাত হেনে এই বাস্তবতাকে ‘ব্ল্যাক কমেডি’ করেছেন। চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের আস্ফালন দেখে বেদনায় চুর হয়ে লিখেছেন বেদনার চল্লিশ আঙুল। তিনি হয়ে ওঠছেন নিঃসঙ্গ, একা, বিচ্ছিন্ন। ভেতরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে তার কবি-সত্তা। যেমন-

‘আমার একজনই বন্ধু,তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী
বহুদিন তার সঙ্গে দেখ হয় না।
..
হ্যাঁ, গতকাল মধ্যরাতে সিরাজীকে দেখেছি শুয়োরের সঙ্গে মেথর পাড়ায়।

..
কী আশ্চর্য! হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কথা বলছেন, জানেন না বুঝি
ও তো চব্বিশ না পেরুতেই মারা গেছে চাটগাঁর নীলিমা হোটেলে।’
(আমার একজনই বন্ধু/শ্রেষ্ঠ কবিতা)

কবি-সত্তার এই যে বিকাশ, বিবর্তন, রূপান্তর, এটাই অনিবার্য পরিণতি। কারণ, ক্রম-অতিক্রমই কবি-সত্তার ধর্ম। আত্মতা ও ব্যক্তিতার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসার পর নিজের কাছে নিজেই অচেনা হয়ে ওঠেন। কাব্য-যাত্রার প্রারম্ভে যে সিরাজীকে আমরা দেখেছি, তিনি এখন নেই- ‘ও তো চব্বিশ না পেরুতেই মারা গেছে’। এই তো নিয়তি এবং পরিণতি কবি ও কবিতার।

তৃতীয় পর্বে হাবীবুল্লাহ সিরাজী নিবিড়, সূক্ষ্ম, সচেতন, প্রাজ্ঞ ও বোধিপ্রাপ্ত। তার দেখার চোখ অনেক তীক্ষ্ম, ক্ষুরধার। তাই কবিতার শব্দ ও পংক্তি ঋজু, লক্ষভেদী, বক্তব্য প্রবাদপ্রতীম-

‘স্বপ্ন গণতান্ত্রিক নয়, একা দেখতে হয়।
একা দেখা স্বপ্নটি
স্টেইলেস স্টিল ছুরি, দুধের ফিডার উল্টিয়ে
মোটাতাজা ভেড়ার মতো আকাশে ফুলতে থাকে
বিপ্লব ডাক দেয়, আয়!
(স্বপ্ন/শ্রেষ্ঠ কবিতা)

অথবা

‘‘হেই লেফটেন্যান্ট
শত মিথ্যে, মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে
প্রজাপতি ম’রে প’ড়ে আছে
..
হে পিঁপড়ে, হে মিথ্যে
হেই লেফটেন্যান্ট
বাতাসে এখনো তার দগ্ধগন্ধ মেলে?’’
(মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে/ শ্রেষ্ঠ কবিতা)

স্বাধীনতা উত্তর সময়ে জাতির জনককে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে যে সামরিক অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে, তাকেই সম্বোধন করে কবি বলছেন- ‘হেই, মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে’। বিশ্বাসঘাতক সময়ের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী। ‘‘প্রজাপতি ম’রে প’ড়ে আছে’’ পংক্তিতে তারই সংক্ষুব্ধ প্রকাশ। মুজিব আদর্শেকে এভাবে ধারণ, লালন ও পরিচর্যা করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে দিয়েছেন মহোত্তম মহিমা। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্য-ভাষা গীতল, স্নিগ্ধ কোমল কিন্তু চেতনার গভীরে আছে বাঙলা, বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির শিল্পিত প্রতিফলন।

সিরাজী ভাইয়ের মহাপ্রয়ানে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন