করোনাকালে যেখানে দেশে দেশে লকডাউন আর প্রবেশে কড়াকড়ি ছিল, সেখানে সাড়ে ৫ হাজার বাংলাদেশি পাড়ি দিয়েছেন ভূমধ্যসাগর। তাদের গন্তব্য ছিল ইউরোপের দেশগুলো। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এ তথ্য জানায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অংশ যায় লিবিয়া থেকে। অন্যান্য দেশের তুলনায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার কাতারে প্রথম সারিতে আছে বাংলাদেশিরাই। আর এ কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারানোর সংখ্যা বাড়তে থাকায় সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
ইউএনএইচসিআর’র তথ্য বলছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৬০ জন বাংলাদেশি নাগরিক ভূমধ্যসাগর এবং স্থলপথে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশ করেছেন। এর মধ্যে স্থলপথ ব্যবহার করে গ্রিস ও স্পেন এবং ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি এবং মাল্টা গেছে। তাছাড়া ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ২৪ মে পর্যন্ত ৭০২ জন মারা গেছেন কিংবা নিখোঁজ আছেন। তারা কোন দেশের নাগরিক তা জানা যায়নি। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন।
সংস্থাটির মার্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম ৩ মাসের তুলনায় ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার হার বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। গতবছরের তুলনায় লিবিয়া উপকূল থেকে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ১৪৩ শতাংশ।
গতবছর সাড়ে চার হাজার শরণার্থী লিবিয়া থেকে ইতালি গেলেও এই বছর ৩ মাসে গেছে প্রায় দেড় হাজার। এই বছরে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশকৃতদের মধ্যে ৬১ শতাংশই লিবিয়া থেকে এসেছে। পাশপাশি লিবিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি ইতালি এবং মাল্টায় প্রবেশ করেছে, সংখ্যায় যা ৭৯৪।
এই তালিকায় অন্যান্য দেশের মধ্যে আছে সুদান (৪১৮ জন), গিনি (৪১৬), ইরিত্রিয়া (৩৭২ জন), আইভরিকোস্ট (৩৪৮জন), মালে (২৯৬ জন), মিসর (২৭৬ জন), মরক্কো ( ২১৮ জন) ক্যামেরুন (১৮২ জন) এবং সোমালিয়া (১৩৮ জন)। এই তালিকায় থাকা বাংলাদেশিরা সবাই ইতালি গেছে বলে জানায় ইউএনএইচসিআর।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় তিনমাসে অন্তত ১৬২ জন মৃত কিংবা নিখোঁজ হয়েছে। যা গতবছরের একই সময়ে ছিল ৬২ জন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম বলছে, এই বছরের ২০ মে পর্যন্ত ৭৪৩ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। সংস্থাটির তথ্য থেকে আরও জানা যায়, গত বছরের প্রথম ৫ মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ১১ জন, এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৭৩৪ জনে। গতবছর পাঁচমাসে ২৯০ জন মারা গেলেও এই বছর মারা গেছে ৭৪৩ জন।
সমুদ্রপথে ইতালি প্রবেশকৃত ১০ শতাংশই বাংলাদেশি
এই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৯ হাজার ১৩ জন সমুদ্রপথে ইতালি প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। গতবছরের এই চারমাসে প্রবেশ করেছিল মাত্র ৩ হাজার ৪৬৫ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল তিউনিসিয়ার নাগরিক (১৫ শতাংশ), আইভরিকোস্টের (১৩ শতাংশ) এবং বাংলাদেশি (১০ শতাংশ)।
মার্চের তুলনায় এপ্রিলে বাংলাদেশীদের প্রবেশের হার কিছুটা কমেছে। চারমাসে ৯৩৯ জন বাংলাদেশি ইতালি প্রবেশ করেছে সমুদ্রপথে।
ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২১ সালে এরই মধ্যে ১০ হাজার অভিবাসী পৌঁছেছে দেশটিতে। গতবছর এই সময়ের চেয়ে যা প্রায় তিনগুণ। ৩ মে ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত হালনাগাদ তালিকায় এই বছর পৌঁছানো অভিবাসীদের সংখ্যা জানানো হয়। এতে দেখা যায়, এ বছর জানুয়ারি থেকে ৩ মে পর্যন্ত ১০ হাজার ১০৭ জন নতুন অভিবাসী পৌঁছেছে ইতালিতে। গতবছর জানুয়ারি থেকে ৩ মে পর্যন্ত দেশটিতে ৩ হাজার ৫৭৩ জন অভিবাসী প্রবেশ করেছিল।
বেড়েছে মৃত্যু
গত ২ মে লিবিয়ার জাউইয়া উপকূলের কাছে নৌকা ডুবে অন্তত ১১ অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। ১২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ভূ-মধ্যসাগর হয়ে ইউরোপের পথে পাড়ি দেওয়া ৬০০ জনেরও বেশি অভিবাসন প্রত্যাশীকে ফিরিয়ে এনেছে স্থানীয় কোস্টগার্ড।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে যে, ২ মে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা ১১ অভিবাসী নৌকা ডুবে মারা গেছে। ২০১৯ সালের মে মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ৪০ বাংলাদেশি। লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে ১৭ মে অভিবাসন প্রত্যাশীদের একটি নৌকা ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। ওই সময় ৩৩ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার নৌবাহিনী।
ওই নৌকার ৫০ জনেরও বেশি এখনও নিখোঁজ। উদ্ধার হওয়া ৩৩ জনই ছিল বাংলাদেশি। ৩৩ জনের মধ্যে ২৩ জনই মাদারীপুরের বাসিন্দা। এই ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জনের বাড়ি সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের নয়াচর এলাকায়।
অভিবাসনের আশায় সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। অবস্থার পরির্বতনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে অভিবাসনের জন্য বৈধ ও নিরাপদ পথ আরও শক্তিশালী করার আহ্বান করেছে সংস্থাটি।
সম্প্রতি স্পেনের টেনেরিফে দ্বীপ সংলগ্ন সমুদ্রে নৌকাডুবির ঘটনার পর এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজি (ইউএনএইচসিআর) এবং ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ মাইগ্রেশন (আইওএম) জানায়, সাগরে শরণার্থী ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিহতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
টেনেরিফের এই দুর্ঘটনায় ২৪ অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা দুটি সব দেশকেই বিপজ্জনক এমন পথের বিকল্প হিসেবে অভিবাসনের জন্য বৈধ ও নিরাপদ পথকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছে।
অন্যদিকে লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুক্রবার (২৮ মে) অবৈধভাবে সাগরপাড়ি দেওয়া বন্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্য কামনা করেছেন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করার তালিকায় বাংলাদেশ এই মুহূর্তে আছে ৪র্থ অবস্থানে। এর আগে ২৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হলো, ৩৩ জন নৌকা ডুবে মারা গেলো। কোন একটা ঘটনা ঘটলে আমাদের কিছুদিন অভিযান চলে। তারপর আবার আগের মতো হয়ে যায়। পাচার হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে পাচারকারী কারা চিহ্নিত করা জরুরি। তেমনি যেসব অঞ্চল থেকে বেশি যায় তাদের আত্মীয়স্বজনরা কিন্তু জেনে বুঝে যাচ্ছে। তারা যেতেও মরিয়া। এই মানুষগুলো যদি সচেতন না হয়, তা হলে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না।