স্মৃতির মণিকোঠায় ৩০ মে ১৯৮১

প্রফেসর ফাহিমা খাতুন

প্রফেসর ফাহিমা খাতুন
প্রফেসর ফাহিমা খাতুন। ফাইল ছবি

১৯৮০তে আমার বিয়ে হয়েছে। ১৯৮১ সনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি। মুকতাদির তখন পুরোদমে ছাত্র রাজনীতি করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৮১-র ১৭ মে সবেমাত্র দেশে ফিরেছেন দলের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে। মে মাসের শেষ দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিনাইরে ( তখন ‘শেকড়’ নাম ছিল না) গেছি শ্বশুড়বাড়ি বেড়াতে। আমাকে রেখে মুকতাদির চলে আসল ঢাকায় সভানেত্রীর সাথে সিলেট সফরে যাওয়ার জন্য। ৩০ মে ভোররাতে ঘটে গেল চট্টগ্রামে সেইসময়ের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড। সেইসময় এত টিভি চ্যানেল, মোবাইল কিছুই ছিল না। কিন্তু গ্রামে বসেও সকাল থেকেই টের পাচ্ছি একটি অস্থির পরিস্থিতির । চিনাইর থেকে তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে যাওয়া এতটা সহজসাধ্য ছিল না। শহরে গুমোট অবস্থা। তারপরও দুই ভাতিজাকে পাঠালাম শহরে গিয়ে ঢাকায় আমার মা’র বাড়িতে ফোন করে ওর খোঁজ নেয়ার জন্য। ওরা ফিরে আসল কোন খবর না পেয়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হচ্ছে এমন সময় একজন এসে বলল, ‘রেল লাইন দিয়ে চাচা আসছেন, সাথে বেশ কয়েকজন আছেন, ভদ্রমহিলা আছেন দু’জন’। আমাদের চিনাইর গ্রামের মাঝখান দিয়ে গেছে ঢাকা- চিটাগাং, ঢাকা- সিলেট রেল লাইন। অতিথিদের নিয়ে বাড়িতে এসেই মুকতাদির আমাকে চুপিসারে তাঁদের পরিচয় দিয়ে দ্রুত খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন।

চরম অস্থিতিশীল এই পরিস্থিতিতে কিছুটা সময় নিরাপদে থেকে ঢাকায় ফেরার পরিকল্পনা নিয়ে সেদিন সিলেট থেকে রেলপথে এসে এই প্রত্যন্ত গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কান্ডারী শেখ হাসিনা। সাথে ছিলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী, জনাব আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, শেখ সেলিম, মোস্তফা মোহসিন মন্টু, তাঁর কন্যা ছোট্ট পুতুল এবং আরও বেশ কয়জন নেতা কর্মী। গাছের ডাব পেড়ে, পালিত মুরগী ধরে দ্রুত অতিথি আপ্যায়ন হল। শেখ হাসিনা নিরাপত্তার জন্যই বোরখা পরে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরেও কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের মানুষ বাড়িতে জড়ো হতে শুরু করলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য। যতই আমরা অস্বীকার করছি তিনি শেখ হাসিনা নন, কেউ বিশ্বাস করছে না। কেউ বলছে আমরা টিভিতে দেখেছি তিনিই শেখ হাসিনা, কেউ বলছে বিচিত্রায় দেখেছি-‘আমরা শেখের বেটিকে দেখতে চাই’। ক্রমশ ভীড় বাড়তে লাগল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, উনারা হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তে নিলেন দ্রুত স্থান ত্যাগের। মুকতাদির (সেইসময় রাজনীতিতে ও রবিউল নামেই পরিচিত ছিল) তাঁদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবেন বলে মাকে আর আমাকে স্বাম্তনা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। গুঁড়ি, গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখন । রাত হল। অপেক্ষা করছি, ওর ফেরার। রাত দশটার দিক আমানুল হক সেন্টু ও কয়েকজন এলেন, নেত্রীর খোঁজে। তাদের কাছেই জানলাম শহরে রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই আছেন, কিন্তু চিনাইর থেকে উনারা শহরে যান নি। চিন্তায় পড়ে গেলাম। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। রাত দুইটার দিকে পুলিশ ঘিরে ফেলল পুরো বাড়ি । তারা শেখ হাসিনাকে চায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরে গেল। আমার এক চাচা শ্বশুড় পুলিসকে বলার চেষ্টা করলেন ‘আমার ভাতিজা বাড়ি আসেনি বহুদিন’। তাতেও তারা গ্রাহ্য করলেন না। আমরা চুপচাপ দাড়িয়ে দেখলাম। নির্ঘুম রাত অবশেষে ভোর হল। এরপর শুরু হল গুজবের ডালপালা ছড়ানো।

প্রফেসর ফাহিমা খাতুন ও র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি।
প্রফেসর ফাহিমা খাতুন ও র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

তাঁরা চিনাইর থেকে প্রথমে রিক্সা ও পরে সুলতানপুর থেকে বেবী ট্যাক্সি নিয়ে শহরের দিকে গেছেন শুনেছিলাম। কিন্তু সকালে প্রত্যক্ষদর্শীর মতই কেউ কেউ বলা শুরু করল, সেই বেবী ট্যাক্সিচালক জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার সাথের সবাইকে সশস্ত্রবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলেছে এবং শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত একই গুজব। ভারতীয় রেডিওর বরাত দিয়ে কেউ বলল খরমপুর দরগাশরীফ থেকে বেগম জোহরা তাজউদ্দিন গ্রেফতার হয়েছেন। এ অবস্থায় আমাদের মনের অবস্থা তখন অবর্ণনীয়।

২/৩ দিন হয়ে গেল মুকতাদির ফিরল না, চারিদিকে ভয়ংকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আমরা দিশেহারা, নির্বাক । ঢাকা থেকে মুরশেদ অনেক কষ্ট করে গেল আমাকে দেখতে। চতুর্থ দিন একটি অচেনা ছেলে আসল আমার সাথে দেখা করতে, কিছুই না বলে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিল। দেখলাম তাতে মুকতাদির দু’টি লাইন লিখে পাঠিয়েছে ‘আমরা যেখানে আছি আপাকে নিয়ে নিরাপদে আছি। তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়ে ফিরব’। মনে হল ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। শ্বাশুড়ী আর আমি এই প্রথম আনন্দে কাঁদলাম। এক /দু’দিন পর ও ফিরে আসল। পরে জানতে পারলাম বৃষ্টির মধ্যে সেই রাতে নৌকা দিয়ে মেঘনা পাড়ি দিয়ে তাঁরা প্রয়াত আইভী রহমানের বাবার বাড়ি ভৈরবের চন্ডিবেড় গ্রামে চলে গিয়েছিলেন । প্রতিবার ৩০ মে এলেই এই দুঃসহ সময়ের কথা মনে পড়ে। এমন আরও অনেক সুখ, দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার জীবনে।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়
ও সাবেক মহাপরিচালক (গ্রেড-১), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।

শেয়ার করুন