জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

করোনা ও বাজেট
প্রতীকী ছবি

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও ছিল ‘আয় অনুযায়ী ব্যয়ের বাজেট’ তৈরি এবং বরং তার ফলে যদি কিছু উদ্বৃত্ত পাওয়া যায়, সেটি ভবিষ্যতের দৈবদুর্বিপাকের জন্য রাখা। ব্যয়কে রাজস্ব আয় অনুগামী করা না হলে ব্যয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ঠেকানো যায় না, ভবিষ্যতের জন্য উদ্বৃত্ত তো দূরের কথা, ব্যয় ধারকর্জ করে চালিয়ে ভবিষ্যতের জন্য দুর্বিপাকের পাল্লা ভারী করা হয়। ইদানীং জনগণের জন্য উন্নয়ন ও কল্যাণের নামে বাহুল্য ব্যয়ের জন্য বাজেটে ব্যয়কে অগ্রগণ্য ভাবা হয় এবং সম্ভব হবে না জেনেও আয় অর্জনের ওপর তা চাপানো হয়। এ অবস্থায় এমন সব খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়, যেখানে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ থাকে না, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকরণের উপায় তাগিদসহ অপচয় আত্মসাৎ দুর্নীতি ঠেকানোর নামমাত্র উদ্যোগ মেলে না। বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণের যেসব পদ্ধতি প্রক্রিয়া প্রভিশন সংবিধানে, সংসদ কার্য পরিচালনা বিধি ও কোডে, ম্যানুয়ালে উল্লিখিত আছে তা কৌটিল্য, কেইনস, অ্যাডাম স্মিথ অনুযায়ী ঠিক থাকলেও তা অনুসরণের সময় যেন কারোরই নেই। তাই জনগণের জাতীয় বাজেটে তেলো মাথায় তেল দিয়ে পক্ষপাতিত্বের, বৈষম্য সৃষ্টির সুযোগ, মৌলিক অধিকার বঞ্চিতকরণের সব ‘আয়োজন’ থাকে। জনগণের পক্ষে বাজেট প্রস্তাব পরীক্ষা-পর্যালোচনা, বিচার-বিশ্লেষণের দায়িত্ব যদি পালিত না হয়, সম্পূরক বা সংশোধিত বাজেট যদি বিনা জিজ্ঞাসাবাদে, বাক্যব্যয়ে, কণ্ঠভোটেই সব ‘আয়োজন’ পাস হয়ে যায়, তাহলে বাজেটের কার্যকারিতা অর্থবহ হয় না।

এটা সবার জানা যে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম ভাগে, আইনসভা অধ্যায়ে, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, ‘আইন প্রণয়ন ও অর্থসংক্রান্ত পদ্ধতি’ অনুযায়ী ৮১ অনুচ্ছেদে সংজ্ঞায়িত ‘অর্থবিল’ই ব্যাবহারিক অর্থে বাজেট। সংবিধানের কোথাও বাজেট শব্দের নাম-নিশানা নেই অথচ লোকসমাজে বাজেট একটি বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত শব্দ। সংসদে সম্পূরক এবং নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশকালে ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে যে ‘বাজেট বত্তৃদ্ধতা’ দেওয়া হয় তা আইনত বাজেট নয়, সেটি পারতপক্ষে অর্থবিলের নির্বাহী সারাংশ; এবং এটিকে বড়জোর সরকারের ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির বার্ষিক বিবৃতি’, কখনোসখনো নির্বাচনী ইশতেহারও বলা যায়। ‘অর্থবিল’ লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়, নথিতে তার অবস্থান ‘সংযোজনী’ হিসেবে। বাজেট প্রস্তাব পেশের পর ‘বাজেট আলোচনা’য় অর্থবিলের পর্যালোচনা প্রাসঙ্গিকতা খুব একটা দেখা যায় না।

universel cardiac hospital

চলতি ও আসন্ন বাজেট বর্ষে করোনাবিধ্বস্ত সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি সামাল দিতে চির চেনাশোনা ও জানা পথে পা বাড়ানোর সুযোগ সত্যিই নেই। এখন বাজেটকে হতেই হচ্ছে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’র, ‘জীবন ও জীবিকা’র, ‘জীবন বাঁচাও, অর্থনীতি বাঁচাও’—এই ধ্যান ও জ্ঞানের। তবে এটি বলে রাখা ভালো যে এ বাজেট জাতীয় বাজেট থেকে আলাদা কোনো বাজেট নয়, এটি হবে যার একটি পরিশীলিত রূপ, বিবর্তিত অবয়ব। যে বাজেটে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে লক্ষ্যমাত্রা (করোনা মোকাবেলায় সক্ষমতা সৃষ্টি, করোনায় বিধ্বস্ত অর্থনীতি গণস্বাস্থ্য জনশিক্ষা পুনরুদ্ধারের মতো জরুরি বিষয়গুলো প্রাধান্য), যে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রকৃত প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় খাতে (এ মুহূর্তে যেমন জীবন ও জীবিকা) যথাযথ (ব্যয়সাশ্রয়ী, অর্থায়ন আয় বৃদ্ধি ও কৃচ্ছ্রসাধন অর্থে ব্যয় সংকোচন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি-বেসরকারি খাত দল-মত-নির্বিশেষে ঐকবদ্ধভাবে দুর্যোগ মোকাবেলায়) ব্যবহার এবং আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর মতো কর্মসংস্থান, বেকারত্ব দূর, সবাইকে ন্যায্য মূল্যে খাদ্য সহায়তা সুযোগ সুনিশ্চিত করা এবং সম্পদের সুষম বণ্টন। বাজেট বাস্তবায়নের দ্বারা সুফলপ্রাপ্তিতে পক্ষপাতিত্ব, একদেশদর্শিতা, বৈষম্য ও বঞ্চনা বৃদ্ধি কিংবা কর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিপক্ষতার পরিবেশ সৃষ্টির অবকাশ আপাতত এক পাশে থাকবে।

মোটা দাগে বলা যায়, এত দিনের চলে আসা বেশ কিছু বাজেট অব্যবস্থাপনা যেমন পাবলিক সেক্টরের অদক্ষতা ও দুর্নীতির দায়ভার বেসরকারি সেক্টরের ওপর চাপানো, সমাজ ও অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তির নামে বিচ্যুতির বিস্তৃতি, উন্নয়ন ব্যয়কে দ্রুত বাস্তবায়ন ও সাশ্রয়ী দৃষ্টিতে আনতে না পারা, বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা রশি টানার পরিবর্তে গত পাঁচ বছর ব্যাপকভাবে কঠিন শর্তের ঋণভারে অর্থনীতিকে নিয়ে যাওয়া, বাজেট বাস্তবায়ন লক্ষ্যভেদী না হওয়া, বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটাতে না পারা, আর্থিক খাতের ক্ষয়িষ্ণু রোগের সুচিকিৎসার মাধ্যমে ভগ্নস্বাস্থ্য এখনো পুনরুদ্ধার না হওয়া, ব্যাংকিং, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় পরিস্থিতি অনুকূলে আনার প্রয়াসে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষের জাতীয় বাজেট করোনা মহামারিকালে বাঞ্ছিত কাঙ্ক্ষিত বাজেটে বিবর্তিত হবে না।

প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত সমপর্যায়ের অনেক দেশের তুলনায় বেশ কম। সামগ্রিকভাবে বিষয়টিও দেখা দরকার। তিন প্রধান কারণে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম। এক. কর আওতার সীমাবদ্ধতা, পরিধিগত ঘাটতি। সব যোগ্য করদাতা ও খাতকে করজালের মধ্যে আনতে পারার দীর্ঘসূত্রতা বা ক্ষেত্র বিশেষে অপারগতা, অক্ষমতা। দুই. ব্যাপক করছাড়, কর রেয়াত, কর ফাঁকি, মামলায় আটকানো, কর্তন কিংবা আদায়কৃত কর রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা না হওয়া। তিন. রাজস্ব বিভাগের দক্ষ লোকবলের অভাব, অদক্ষতা, অপারগতা, মনিটরিংয়ের দুর্বলতা, কর আইন ও আহরণ ও প্রদান পদ্ধতির জটিলতা, মনোভঙ্গি পরিবর্তনের আবশ্যকতা। করের আওতা সীমিত, জুরিসডিকশন আসলে বাঞ্ছনীয়ভাবে বাড়ছে না। অর্থাৎ সক্ষম সব করদাতা এবং প্রযোজ্য সব খাত করজালের আওতায় আসেনি। ফলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। যেকোনো দেশে জিডিপির অন্তত ১৫-১৬ শতাংশ কর হিসেবে আহরিত হয়। কিন্তু আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত ১০-১১ শতাংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ঘোরাফেরা করছে। এ বছর নানা সংগত কারণে এটি ৭-এ নেমে এসেছে। সেখান থেকে ভ্যালু এডিশন ভেদে করের আওতা বাড়ানোর সুযোগ অমনোযোগিতার শিকার। আওতার ব্যাপারে আরেকটি কথা হলো, অর্থনীতি বড় হচ্ছে। এটি ধারাবাহিকভাবে গ্রো করেনি। নব্বইয়ের দশক থেকে হঠাৎ করে বড় হচ্ছে অর্থনীতি। আর বড় হচ্ছে যেসব খাত তা হলো তৈরি পোশাক, আবাসন, নির্মাণশিল্প, সেবা, বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ, আর্থিক খাত, টেলিকম, ওষুধ প্রভৃতি। আরো কিছু খাত উঠতি। এসব খাতে অনেক মুনাফা হচ্ছে, মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অথচ এঁদের অনেকে করের আওতায় ভালো করে আসছেন না। কর অবকাশের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে, শিল্প উৎপাদনক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় আসতে কর অবকাশের সুযোগ ব্যবহার ইতিবাচক প্রবণতায় আসতে বিলম্ব হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্পের নাম করে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এখনো নানা ধাঁচের কর রেয়াত সুবিধা নিচ্ছেন এবং যথেষ্ট কম কর দিচ্ছেন। শুল্ক ও কর রেয়াতের মাধ্যমে উল্টো প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। রিহ্যাবের কাছ থেকে বাড়ি বিক্রি বাবদ তেমন করই সরকার পায় না। তারা কত লাভ করছে, সেটিও স্পষ্ট হচ্ছে না। শহরের বাড়িগুলো জরিপ করার উদ্যোগ বারবার নেওয়া হয়। প্রতি বাড়িওয়ালাকে করের আওতায় আনার কাজ শেষ হয়েও এখনো শেষ হয়নি এবং অনেককেই করের আওতায় আনা হয়নি। যেখানে যেখানে অর্থনীতি দৃশ্যমান হচ্ছে বা বড় হচ্ছে, সেগুলো আসলে করের আওতায় আনার ব্যাপারে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার দুর্বলতা বা অপারগতার সুযোগে রাজস্ব আয় অর্জিত হচ্ছে না। তার ওপর এই খাতে কালো টাকা করবঞ্চিত করে স্বল্প হারে কর দিয়ে এবং উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। করদাতা এবং কর আহরণকারী উভয় পক্ষের দায়দায়িত্ব যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে না। দেশ থেকে বিদেশিরা গড়ে সাত-আট বিলিয়ন রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছে। বিদেশ কর্মীদের করের আওতায় আনার বেলায় অপারগতা, জবাবদিহিবিহীন থেকে যাচ্ছে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

শেয়ার করুন