২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, প্রস্তাবিত এ বাজেট দুর্বল এবং এটি বাস্তবায়নে সামনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সিপিডির ফেসবুক পেজে সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সামগ্রিকভাবে বাজেট ভালো করতে কিছু চেষ্টা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কভিডকালীন বাজেট হিসেবে যদি এটিকে দেখি, একদিকে কভিডকে মোকাবেলা করা এবং অন্যদিকে কভিড থেকে ফিরে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করার যে বাজেটটি প্রয়োজন ছিল এটায় সেটি আমরা লক্ষ্য করিনি। আগামী কয়েক বছরে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্য খাতগুলো কেমন হবে সে বিষয়ে একটা পরিষ্কার দিকনির্দেশনা থাকা উচিত ছিল। এছাড়া আমাদের অন্য পরিকল্পনা- যেমন: অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো আছে সেটার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজেটটি করা উচিত ছিল। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে এবারের বাজটটি দুর্বল অনুমিত এবং বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কভিডকালীন একটি বাজেট। এটি আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বাজেট এবং মহামারিকালের দ্বিতীয় বাজেট। এটি এমন একটি সময়ে উপস্থাপিত হলো যখন আমরা করোনার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আমরা গতবার বলেছিলাম এবং এবার আরও জোর দিয়ে বলেছি টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলা করা, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সরকারি বিনিয়োগ ও ব্যয় বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং সর্বোপরি কভিড থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য একটি মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা দাঁড় করানো গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
তিনি বলেন, যে বাজেটটি আমরা দেখলাম এটি কোন প্রেক্ষিতে প্রণীত হলো, সেটি একটি বিবেচনার বিষয়। কারণ আমরা যখন বাজেট বিশ্লেষণ করব তখন প্রেক্ষিতটিও বিবেচনা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত অর্থবছরের বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিক ছিল, আবার কিছু দুর্বলতাও ছিল। সেসময় রাজস্ব খাতে একটা ঘাটতি ছিল বড় রকমের, এটা কয়েক বছর থেকেই চলছিল এবং করোনার সময়ে আরও বেড়েছে। সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং সরকারি বিনিয়োগের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতি, বার্ষিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার অত্যন্ত নিম্ন থাকাসহ অনেক দুর্বলতাই ছিল। এছাড়াও ক্ষুদ্র শিল্পে উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ইতিবাচক দিকে রয়েছে রপ্তানি ও আমদানির গতিধারা কিছুটা ফিরে আসা, ঊর্ধ্বমুখী রেমিট্যান্স প্রবাহ, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) স্বস্তিদায়ক অবস্থা, মুদ্রার স্থিতিশীল বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়া ইত্যাদি।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এই অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। গেল অর্থবছরে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসাব দেখানো হয়েছে। আমরা বলছি যে, অর্থনীতির অন্যান্য যেসব সূচক দেখা যাচ্ছে সে সূচকের প্রেক্ষিতে দেখানো এই প্রবৃদ্ধি (গত অর্থবছরে) একটু বেশি। এমন হার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। সেইদিক থেকে দেখলে গত অর্থবছরের লো-বেঞ্চমার্ক থেকে নতুন অর্থবছরে ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন বাস্তবোচিত হবে না। এছাড়াও সামষ্টিক অর্থনীতির যে কাঠামো (রাজস্ব আয়/ব্যয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি) দেওয়া হয়েছে সেটি বাস্তবোচিত হয়নি বলে আমরা মনে করছি। আমরা আরও দেখছি যে রাজস্ব কাঠামোতে তেমন কোনো পরিবর্তন নাই। সংশোধিত বাজেটের সঙ্গে যদি আমরা তুলনা করি, গত দশ মাসে বাজেট বাস্তবায়নের হারের দিকটি দেখলে রাজস্ব কাঠামোর সঙ্গে একটি অমিল দেখতে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘রাজস্ব আয় ৩০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রাটি বেশি বলে আমাদের মনে হয়েছে। বাজেট অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা কাঠামোগত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। অর্থায়নে বিদেশি উৎসের বিষয়টিকে ‘ওয়েলকাম’ সঠিকভাবেই করা হয়েছে। ঘাটতি বাজেটটা বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করতে পারলেই ভালো। তবে বিদেশি ঋণের অবস্থা যেন স্বস্তিদায়ক অবস্থাতেই থাকে সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে।
রাজস্ব আহরণের বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজস্ব আহরণের নীতিমালা বা পদক্ষেপগুলো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে নয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্য করে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এগুলো বাস্তবোচিতই মনে হয়েছে। এসব পদক্ষেপ ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যয় কমাবে এবং করোনাকালে এটি ইতিবাচক। একই সঙ্গে এসএমইতে স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়টিও আমরা সমর্থন করি। তবে উপরের বা নিচের দিকের করসীমা না বাড়ানোয় আমরা মনে করি করের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদি নিচের দিকে মানুষের করসীমা বাড়ানো হতো তাহলে তাদের হাতে খরচ করার টাকা বেশি থাকতো। তাতে ভোগ বাড়তো ও সামগ্রিক চাহিদা বাড়ার কারণে বিনিয়োগও বাড়তো। এটি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতো।
সরকারি ব্যয়ের বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সরকারি ব্যয়ের বর্ধিত বরাদ্দের এক তৃতীয়াংশই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন্য দেওয়া হয়েছে। আমরা বলছি যে, উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে হবে এবং অনুন্নয়ন ব্যয় বা পরিচালন ব্যয় যতোটা সম্ভব সংকুচিত করে সাশ্রয় করতে হবে। এই টাকাটা আমরা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করতে পারবো, বিনিয়োগ করতে পারবো বা এটা দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারবো।
টিকার জন্য বাজেটের ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পরিমাণ অন্য বছরগুলোর মতোই আছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ ছিল, নতুন অর্থবছরেও এটি একই আছে। স্বাস্থ্যখাতে আমাদের বেশি বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, বরাদ্দ দিলেও সেটি বাস্তবায়ন হবে কি-না, কেননা গত অর্থবছরে আমরা দেখলাম বাস্তবায়নের হার স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম। আমরা বলছি, এই খাতে স্বল্পকালীন পর্যাপ্ত অর্থ রাখার পাশাপাশি এই অর্থের যথাযথ ব্যবহারের লক্ষ্যে মধ্যমেয়াদে সংস্কার কাজগুলো চালিয়ে যেতে হবে। স্বাস্থ্য খাতটাকে পুরো ঢেলে সাজানোর কাজটা এখনই শুরু করতে হবে। গত এক বছরে আমরা সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাইনি- এটা খুবই দুঃখজনক।
সামাজিক নিরাপত্তা খাত নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এই খাতে বরাদ্দ কিছু বেড়েছে। তবে আগের সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যুক্ত করে বড় আকার দেখানো হয়েছে। সামাজিক খাতের পেনশনের আকৃতি যতোটা বেড়েছে, সামাজিক নিরাপত্তার নেট অংশটি সেভাবে বাড়েনি। সুতরাং, এখানেও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
শুক্রবার সকাল ১১টায় বাজেট নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হবে বলেও জানান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।