করোনাকাল মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (০৩ জুন) আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রীর ভাষায় এবারের বাজেট হবে ‘মানুষের জন্য’। জাতীয় সংসদের চলমান বাজেট অধিবেশনে বিকাল তিনটায় এ বাজেট উপস্থাপিত হবে। এর আগে জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভা কক্ষে বিশেষ বৈঠকে বাজেট অনুমোদন করা হবে। এর পর মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত বাজেট সংসদে উপস্থাপনের অনুমতি দিয়ে তাতে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর করবেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তিনি আজ বৃস্পতিবার বঙ্গভবনের বদলে জাতীয় সংসদ ভবনের রাষ্ট্রপতির দফতরে অফিস করবেন। এর পরই অর্থমন্ত্রীকে সংঙ্গে নিয়ে সংসদের অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্যখাতকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা এবারের বাজেটের আকার দাড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আহম মুস্তফা কামালের এটি তৃতীয় বাজেট, বাংলাদেশের জন্য এটি হবে ৫০তম বাজেট। পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৮তম বাজেট হলেও ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান সরকারের টানা ১৩তম বাজেট। এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শাহ্ এ এসএম কিবরিয়া পাঁচটি বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, করোনার কারণে বিনিয়োগ কম হয়েছে। মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। জমানো পুজি ভেঙে খেয়েছে সাধারণ মানুষ। মোট কথা অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ কারণে সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান, বাড়ানো, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি বিশেষ নজর দিতে চায়। এ জন্য বাজেটে দিক নির্দেশনা রয়েছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে চলতি অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় আগামী বাজেটেও করপোরেট করে ছাড় দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে ঢালাওভাবে সব খাতে না দিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত শিল্পের কর কমানো হচ্ছে বলে সূত্র জানায়। তবে নতুন কোনও মেরুকরণ না হলে এবার বাজেটে অপরিবর্তিত থাকছে মার্চেন্ট ব্যাংক, সিগারেট, জর্দা ও গুলসহ তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি এবং তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত মোবাইল কোম্পানির কর হার। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি করপোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে বলে ধারণা করছে সরকার। পাইকারি ব্যবসায়ী, পণ্য পরিবেশক, ব্যক্তি মালিকানাধীন (প্রোপাইটরশিপ) প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের ওপর ন্যুনতম কর কমানো হচ্ছে বলে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে। এবারও মুল অর্থনীতিতে যুক্ত করতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে।
জানা গেছে, সরকারের সম্পদ কমিটির সভায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করলেও পরবর্তীকালে তা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ও দিক নির্দেশনায় বজেটের আকার বেড়ে দাড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এই বাজেট চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল বাজেটের তুলনায় ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি। এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ দশমিক ২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে এ ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৬ শতাংশ।
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটের ঘাটতি মোকাবিলায় জাতীয় সঞ্চয়পত্র খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা। বাজেটে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এডিপি এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) অনুমোদন করা হয়েছে। সূত্র জানায়, আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। করোনা পরিস্থিতিতে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ও বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ মিলিয়ে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর বাবদ পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত করের পরিমাণ ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ১৬ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া পাওয়া যাবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক সহায়তা বাবদ পাওয়া যাবে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এবারের বাজেটের অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে তিনটি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। খাত তিনটি হচ্ছে- স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তা। নতুন বাজেটে মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় টিকাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল থাকছে। যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বরাদ্দের অতিরিক্ত। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে বরাদ্দ দেওয়া রয়েছে নতুন বছরের বরাদ্দ তার তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। কারণ বহুদিন উৎপাদনের চাকা ঘোরেনি। নিম্ন আয়ের মানুষ জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম ভোগান্তি মোকাবিলা করছে। বেড়েছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা। বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে এবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আকার ও বরাদ্দ দুটোই গুরুত্ব পাচ্ছে। বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার পরিমাণ।
নতুন বাজেট সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, এবারের বাজেট হবে শুধুই মানুষের জন্য। এখানে আগামী দিনের অর্থনীতি আরও মজুত করতে দিক নির্দেশনা রয়েছে, যা বাজেট প্রস্তাবনায় পাওয়া যাবে।