করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) থাবায় হুমকির মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি। কর্মহীন বহু মানুষ। খাদ্য সংকটে ভুগছে বিশাল জনগোষ্ঠী। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার দেশের জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের উত্থাপিত দেশের ৫০তম এই বাজেটকে ‘জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর আত্মনির্ভরশীল বাজেট’ বলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে এই বাজেটকে ‘গণমুখী, উন্নয়নমুখী ও জনবান্ধব’ আখ্যা দিয়ে রাজধানীতে আনন্দ মিছিলও করেছে দলটি।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, করোনার এই থাবা থেকে মানুষ বাঁচানো ও অর্থনীতি সচল রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের। এই বাজেটে মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনীতি সচল রাখার বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কর্মসৃজন, বিনিয়োগ ও উন্নয়নে বাজেটের ৩২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে—পিছিয়ে পড়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং তাদের জীবনমান ও জীবিকার উন্নয়নের বিষয়টি। কমানো হয়েছে বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরতা।
বাজেট প্রস্তাবনার পরপরই প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। ছয় লাখ কোটি টাকার এ বাজেট জনবান্ধব ও উন্নয়নবান্ধব। জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের সব মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে বাজেটটিতে। এটি একটি বাস্তবভিত্তিক, সংকটকালীন সময়োপযোগী বাজেট।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মাদ ফারুক খান বলেন, উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এবারের বাজেট উপস্থাপনকে স্বাগত জানাই। এই বাজেটের প্রধান লক্ষ্য, পিছিয়ে পড়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং তাদের জীবনমান ও জীবিকার উন্নয়ন। প্রায় ৩০ শতাংশের ওপরে সামাজিক সুরক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ ধরা হয়েছে, এগুলো ভালো লক্ষণ।
আওয়ামী লীগের এ নেতা আরও বলেন, আমি মনে করি এবারের বাজেটে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। প্রথমত, রাজস্ব আদায়। রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকার বাজেটে বিভিন্ন রকম ব্যবস্থার কথা বলেছে। অন্যান্য বার ৫ শতাংশ বাজেট ঘাটতি হলেও এবার ৬ শতাংশ রাখা হয়েছে। এটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও হয়। বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য কিছুটা বিদেশি ঋণের দিকেও আমরা তাকাচ্ছি। যতটুকু আমরা জানি, আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমাদের বর্তমান প্রবৃদ্ধি দেখে সন্তুষ্ট। সুতরাং তারা আমাদের প্রয়োজনীয় ঋণ দেবে। কারণ তারা জানে ঋণ ফেরত দিতে আমরা সক্ষম। এই বাজেট বাস্তবায়নে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো—কোভিড-১৯ এর কারণে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের যেসব সমস্যা আছে। তৃতীয়ত, জনগণের জীবিকার উন্নয়ন। এর জন্য যে প্রণোদনার প্যাকেজগুলো ঘোষণা করা হয়েছে, এগুলো যেন সঠিকভাবে জনগণের হাতে পৌঁছে সেগুলোই চ্যালেঞ্জ হবে। আমি বিশ্বাস করি, গত এক বছরে আমরা যেভাবে করেছি, সেভাবেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবো।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, এই বাজেট উন্নয়নমুখী বাজেট। এটি করোনা মহামারি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করার বাজেট। আমরা মনে করি, দেশকে ২০৪১ সালের আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে এই বাজেট তৈরি করা হয়েছে। এ বাজেট দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করবে। এটা একটা গণমুখী ও জনবান্ধব বাজেট।
দলটির আরেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, এই বাজেটে বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়া অংশ, শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষ, কৃষিজীবী ও প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে করোনায় পিছিয়ে পড়া অংশকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সর্বাধিক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। প্রণোদনা বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে দেখা হয়েছে। আমরা আশা করি, গণমুখী-জনকল্যাণমুখী এ বাজেট আমাদের লক্ষ্য পূরণে ঘুরে দাড়ানোর সহায়ক হবে। এই বাজেটের মধ্য দিয়ে আমরা আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবো।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, এই মুহূর্তে সমগ্র বিশ্বেই মানবিক বিপর্যয় চলছে। আমাদের মত অর্থনৈতিক অবস্থা ও অতি জনবহুল দেশের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্যসহ মৌলিক চাহিদা, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। উপরন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা ও ভয়াবহতা এবং মানবিক সঙ্কট মোকাবিলা বড় চ্যালেঞ্জ। এসব কিছু ধারণ করে সরকার এই বাজেট পেশ করেছে। আমার বিশ্বাস উন্নয়ন ও মানবকল্যাণের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন ও টেকসই করতে এই বাজেট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারির মধ্যে সব কিছু স্থবির হয়ে গেছে। করোনার দ্বিতীয় ওয়েভের মধ্যে আশঙ্কা আছে তৃতীয় ওয়েভেরও। এর মধ্যে বড় বাজেট দিয়েছে সরকার। যাতে প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। স্বাস্থ্যখাত ও করোনায় প্রণোদনা প্যাকেজের পরই কর্মসৃজনে বিনিয়োগ ও উন্নয়ন অগ্রাধিকারে রাখা হয়েছে।
এই বাজেটকে আত্মনির্ভরশীলতার বাজেট উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈদেশিক সহায়তা শুধু ০.৭ শতাংশ রাখা হয়েছে। বৈদেশিক ঋণও অনেক কম; মাত্র ১৩ শতাংশ। এছাড়া বিশ্বের অনেক দেশে করোনা মহামারির কারণে বড় ধরনের বাজেট ঘাটতি রয়েছে। আমাদের ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মত। এটা খুব স্বাভাবিক। মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে; ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৭।
ড. সেলিম বলেন, এখন আমাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার বেঁচে থাকা, নিরাপদ থাকা এবং অর্থনীতি সচল রাখা। সেটাই এবারের বাজেটে দেখা হয়েছে। গতবারের বাজেট এবং এবারের বাজেট প্রায় একই। এটি আমাদের সক্ষমতারও প্রমাণ। এনবিআরের মাধ্যমে কর আদায় আগে ছিল ৬০ শতাংশ, এবার ৫৮ দশমিক ০১ শতাংশ। এনবিআর বহির্ভূত কর আদায় হবে ১৯.০৪ শতাংশ।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের ২১তম গণমুখী বাজেট পেশ উপলক্ষে দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় আনন্দ মিছিল করেছেন নেতাকর্মীরা। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এই আনন্দ মিছিলের আয়োজন করে।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মোকাবিলার কার্যক্রমসহ জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে বৃহস্পতিবার ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এই বাজেট মোট জিডিপির ১৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরের বাজেট বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের এই অর্থ জোগান দিতে রাজস্ব, অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণের শরণাপন্ন হবে সরকার।