প্রতিবছর ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর হাটে রাজধানীবাসীর ভিড় থাকে উপচে পড়া। তবে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে হাট কেন্দ্রিক আমেজে অনেকটা ভাটা পড়েছে। গত বছরও করোনা সংক্রমণ রোধে রাজধানীর সব পশুর হাটে জনসমাগম নিয়ন্ত্রিত ছিল। এবারও করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় রাজধানীর পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জন্য।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মোকাবিলায় বিধিনিষেধ চলমান। আসন্ন কোরবানির ঈদে পশুর হাটে যদি স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে করোনা সংক্রমণ অনেক বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় গাবতলী স্থায়ী পশুর হাট ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় সারুলিয়া স্থায়ী পশুর হাট ছাড়া আরও ২৩টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। সব মিলে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এবার ২৫টি কোরবানির পশুর হাট বসবে। তবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সংখ্যা আরও কমতে পারে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির স্থায়ী সারুলিয়া পশুর হাটের পাশাপাশি আরও ১৩টি স্থানে হাট বসবে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটির স্থায়ী গাবতলী পশুর হাটের পাশাপাশি আরও ১০টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশন বলেছে, হাট বসানোর ক্ষেত্রে মানা হবে স্বাস্থ্যবিধি। যদিও এই করোনাকালের মধ্যে হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ তাদের জন্য। কারণ রাজধানীর হাটে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোরবানির পশু নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। এছাড়া হাটে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় থাকে প্রতিবারই। এসব কিছু মিলিয়ে এতো মানুষের সমাগমের মধ্যে করোনার সংক্রমণ এড়াতে হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সিটি করপোরেশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত বছর করোনাকালে হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানানো লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল কর্তৃপক্ষ। এবারও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, কোরবানির পশুর হাটের নির্ধারিত সীমানা বহাল থাকবে। ইজারা গ্রহীতা নিজ ব্যবস্থাপনায় হাটের চৌহদ্দি সংরক্ষণপূর্বক চৌহদ্দির বাইরে যাতে পশুর হাট প্রসারিত না হয় তা নিশ্চিত করবে। এছাড়া হাটের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব কর্মী নিযুক্ত করবে। হাটের মধ্যে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখা যাবে না। একটি নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা আর্বজনা রাখতে হবে। ইজারা গ্রহীতাকে হাটে পর্যাপ্ত সংখ্যক অস্থায়ী টয়লেট স্থাপন করতে হবে। হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক সাবান রাখতে হবে। গায়ে জ্বর থাকলে কাউকে হাটে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। হাটে প্রত্যেক প্রবেশকারীকে গ্লাভস, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হাটে প্রবেশ করতে হবে।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রণীত স্বাস্থ্যবিধি সম্বলিত ব্যানার, পোস্টার টাঙ্গানোসহ মাইকে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে হবে। জীবাণুনাশক দিয়ে হাটের সর্বত্র ও আশপাশের সংশ্লিষ্ট জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ক্রেতা, বিক্রেতা ও ইজারাদারের নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সবাইকে মাস্ক পরে হাটে আসতে হবে। হাটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাবান, পানির ড্রাম ও বেসিন রাখতে হবে। হাঁটে প্রবেশ এবং বের হওয়ার পৃথক গেইট করতে হবে এবং নির্ধারিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটে প্রবেশ-বের হতে হবে। বয়স্ক, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিকে হাটে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
হাটে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, হাট মানেই প্রচুর লোকের সমাগম। যে কারণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। এ বিষয়ে আমরা একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম, সরকারি আয়োজনে কোনো দামাদামি না করে একদামে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করা যেতে পারে। তারপরও যদি হাট বসাতেই হয় সেক্ষেত্রে কার্যকরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে করোনাকালে হাট যত কম করা যায় ততই উত্তম। হাট মানেই অতিরিক্ত মানুষের আনাগোনা। তাই হাটের সংখ্যা যত কম করা যায় তাতেই সবার উপকার হবে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাট বিষয়ক সংশ্লিষ্টদের মধ্যেও রয়েছে হাটের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কমিটির কিছু কিছু সদস্য মনে করছেন, হাটের সংখ্যা যত কমানো যায় ততই ভালো। তবে আরেক পক্ষ মনে করছে, হাটের সংখ্যা বেশি বাড়ালে জনসমাগম কম হবে। ফলে করোনার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে। কারণ নিজ নিজ এলাকার বা আশেপাশের এলাকার লোকজন নির্দিষ্ট হাটেই উপস্থিত হবেন। দূরের হাটে আর যাবেন না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা গেছে, সারুলিয়া পশুর হাট ছাড়া আরও যে ১৩টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট বসবে এর মধ্যে রয়েছে, মেরা-দিয়া বাজার-সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, গোপীবাগ বালুর মাঠসহ কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গা, দনিয়া কলেজ মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, ধূপখোলা ইস্টঅ্যান্ড ক্লাব সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল সংলগ্ন উন্মুক্ত জায়গা, উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজার মৈত্রী সংঘের ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, হাজারীবাগ এলাকায় ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি মাঠসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, আফতাবনগর (ইস্টার্ন হাউজিং) ব্লক-ই, এফ, জি, এইচ সেকশন ১ ও ২ এর খালি জায়গা, আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গা, লালবাগের রহমতগঞ্জ ক্লাব সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, শ্যামপুর-কদমতলী ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন খালি জায়গা, গোলাপবাগে সিটি করপোরেশন মার্কেটের পেছনের খালি জায়গায় এবং পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্রে জানা গেছে, উত্তরে গাবতলী স্থায়ী পশুর হাট ছাড়া আরও যে ১০টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট বসবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং ব্লক-ই সেকশন ৩ এর খালি জায়গা, উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর ব্রিজের পশ্চিমের অংশ, ২ নম্বর ব্রিজের পশ্চিমে গোলচত্বর পর্যন্ত সড়কের ফাঁকা জায়গা, মিরপুর সেকশন ৬ ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠ, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর এলাকায় অবস্থিত বৃন্দাবন থেকে উত্তর দিকে বিজিএমইএ পর্যন্ত খালি জায়গা, ভাটারা (সাইদনগর) পশুর হাট, কাওলা শিয়ালডাঙ্গা সংলগ্ন খালি জায়গা, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বাচল ব্রিজ সংলগ্ন মস্তুল ডুমনী বাজারমুখী রাস্তার উভয় পাশের খালি জায়গা এবং উত্তরখান মৈনারটেক শহীদনগর হাউজিং প্রকল্পের খালি জায়গা।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, স্থায়ী একটি হাটের পাশাপাশি আরও ১৩টি হাটের স্থান আমরা নির্ধারণ করেছি। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের কমিটি যদি মনে করে এর সংখ্যা কমানো প্রয়োজন, তাহলে নির্ধারিত হাটগুলো কমেও যেতে পারে। করোনা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে হাটের সংখ্যা চূড়ান্ত করা হবে।
ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, হাটের সংখ্যা কতটি হবে তা জানা যাবে জুনের ১০ তারিখের পর। হাটের সংখ্যা বাড়তেও পারে, আবার করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে হাটের সংখ্যা কমেও যেতে পারে।