একসময় ছিলেন ঢাকার মগবাজারের একটি বিকাশ এজেন্টের দোকানে কর্মচারী। কিছুদিন চাকরি করার পর নিজেই শুরু করেন ব্যবসা। জমা নিতেন গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল। প্রায় দেড় হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করেন কয়েক কোটি টাকা। কিন্তু বিপুল অংকের এই টাকা জমা না দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। এক গ্রাহকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন ওমর ফারুক।
গ্রেপ্তার ফারুকের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে সোমবার বিকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে র্যাব। সেখানে ফারুকের প্রতারণার বর্ণনা দেন র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
তিনি জানান, ২০১৮ সাল থেকে রাজধানীর মিরপুর-২ এর ৬০ ফিট এলাকায় ‘ইন্টার্ণ ব্যাংকিং এন্ড কমার্স’ নামে একটি এজেন্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান করে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন ওমর ফারুক। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যম তিতাস গ্যাস, ওয়াসা ও ডেসকোর গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল সংগ্রহ করা হতো। প্রায় দেড় হাজার গ্রাহক দুই বছর ধরে ওমর ফারুকের প্রতিষ্ঠানে বিল দিলেও তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা হয়নি। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি ১০ কোটি টাকার বেশি জমা নিলেও তা জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করে। পরবর্তীতে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বকেয়া বিলের জন্য গত জানুয়ারিতে মিরপুর এলাকায় মাইকিং করে। এসময় তারা জানায়, দ্রুত টাকা না দেওয়া হলে দেড় হাজার গ্রাহকের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। ওই মাসেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে পালিয়ে যায়। পরে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা প্রতারক ফারুকের প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করে রাস্তা অবরোধ করে।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক আরও বলেন, ওমর ফারুকের সহযোগিতা করতে তিতাসের কেউ জড়িত ছিল কি-না তা খতিয়ে দেখছে র্যাব। যদি কেউ জড়িত থাকে তাহলে আমরা তিতাস কর্তৃপক্ষকে বিস্তারিত জানাবো। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রতারিত সবাই মামলা করলে তারা ভবিষ্যতে ক্ষতিপূরণ দিতে পেতে পারেন বলেও জানায় র্যাবের এই কর্মকর্তা।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক আরও জানান, ২০১৮ সাল থেকে এমন জালিয়াতি করে আসছে ফারুক। এজেন্ট ব্যাংকিং প্রতারণা ছাড়াও সে ‘অঁটুট বন্ধন’ নামে একটি এমএলএম প্রতিষ্ঠান চালু করে। সেখানেও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে সে। এছাড়াও সে ‘নব ক্যাশ’ নামে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করেছিল। যা সবই অবৈধ।
ওমর ফারুকের উত্থান যেখাবে
প্রতারক ওমর ফারুকের বাড়ি নোয়াখালীর কবিরহাটের সাগরপুরে। ২০০৯ সালে এসএসসি পাসের পর ২০১৪ সালে ঢাকায় এসে মগবাজারে একটি বিকাশের দোকানে চাকরি নেয়। কিছুদিন চাকরি করার পর মিরপুরের আহম্মেদনগর এলাকায় নিজে বিকাশের ব্যবসা শুরু করে। প্রতারণার উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে সে বিভিন্ন ব্যাংকে পাঁচটির বেশি একাউন্ট খোলে। পরবর্তীতে ‘ইন্টার্ণ ব্যাংকিং এন্ড কমার্স নামে একটি এজেন্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। ওমর ফারুক তার এজেন্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এলাকার গ্রাহকের গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করত। গত ২০১৮ সাল থেকে তিতাস গ্যাস, ওয়াসা ও ডেসকোর গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল সংগ্রহ করে জমা না দিয়ে বিলের টাকা আত্মসাৎ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
ভুক্তভোগীরা যা বলছে
ভুক্তোভোগী মো. আক্তার মোল্লা স্থানীয় একটি চারতলা বাড়ির মালিক। তিনিও গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল জমা দেন ওমার ফারুকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রতিষ্ঠানে। তার পানি ও বিদ্যুৎ বিল জমা হলেও গ্যাস বিল জমা হয়নি।
আক্তার মোল্লা বলেন, ২০১৮ সালে মিরপুরের ৬০ ফিটের বিভিন্ন বাসায় গিয়ে ওমর ফারুক সবাইকে তার এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে বিল জমা দিতে বলে। বাড়ির কাছে বিল জমা দেয়ার সুযোগ থাকায় সবাই সেখানে বিল দেয়া শুরু করে। তবে গ্যাস বিল জমা দেয়নি।
আক্তার মোল্লা অভিযোগ করেন, এর আগে বিল জমা হলে খোঁজ নিত তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওমর ফারুকের এজেন্টের মাধ্যমে বিল দেয়ার পর দুই বছর ধরে তিতাস আর খোঁজ নেয়নি। আমার অভিযোগ হলো, তিতাস বিল না পেয়েও দুই বছর চুপ ছিল কেন? তারা নিশ্চয় জড়িত। তারা জানত?।
হৃদয় নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, ওমর ফারুক মার্কেন্টাইল ও সিটি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করেছে। তার প্রতিষ্ঠানে সবাই সেভিং অ্যাকাউন্টে টাকাও জমা নিত। টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাবার পর তিতাস মাইকিং করে জানিয়েছে তারা বিল পায়নি। তারা যদি আগে গ্রাহকদের জানাতো তাহলে ওমর ফারুককে তখনই গ্রেপ্তার করা যেতো।
তাদের ধারণা, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ওমরের সঙ্গে আঁতাত করে টাকা আত্মসাৎ করেছে। কারণ এর আগে বিল জমা না দিলে তিতাস গ্রাহকদের বিল চাইতো। কিন্তু ওমরের এজেন্ট ব্যাংকিং বিল জমা দেয়ার দেড় বছরে বিল চায়নি তিতাস।