সংবিধানে এনআইডি সেবার বিধান অন্য কাউকে দেয়া হয়নি: নির্বাচন কমিশন

নিজস্ব প্রতিবেদক

এনআইডি
ফাইল ছবি

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চিঠিতে এ ব্যাপারে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থাকে ভোটার তালিকা করা, হালনাগাদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়নি।

মঙ্গলবার (৮ জুন) ইসির উপ-সচিব (সংস্থাপন) মোহাম্মদ এনামুল হক স্বাক্ষরিত চিঠিটি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো হয়।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ইসি ২০০৭-৮ সালে আদালতের নির্দেশনা এবং আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দাবির প্রেক্ষিতে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইসির এ কার্যক্রমকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কনসালটেন্ট, যন্ত্রপাতি এবং কারিগরি জনবল সরবরাহের জন্য ইউএনডিপি অন্য আটটি দেশের সহায়তায় পুল ফান্ড সরবরাহ করে। পুল ফান্ডের সহায়তায় ৮ কোটি ১০ লাখ ভোটারের ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন প্রকল্পের (পিইআরপি) আওতায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশের জন্য একটি কম্পিউটারাইজড ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। সংগৃহীত তথ্য ভাণ্ডার বারবার ব্যবহার করার লক্ষ্যে একটি ডেটা সেন্টার এবং দ্বৈত ভোটার চিহ্নিত করতে একটি অ্যাফিস সিস্টেম সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

ইসি আরও জানায়, ভোটার তালিকা প্রণয়নকালে ভোটারদের নিকট হতে সামান্য কিছু বাড়তি তথ্য সংগ্রহ করে ভোটারদের একটি পরিচয়পত্র সরবরাহ করা হয়। যা পরবর্তীকালে জাতীয় পরিচয়পত্রে রূপ নেয়। ভোটার তালিকার জন্য নাগরিকদের সংগৃহীত তথ্য দ্বারা একই জনবল, অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যবহার করে ভোটার তালিকার তথ্য থেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০-এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতের দায়িত্ব দেয়া হয়। উক্ত আইনে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ভোটার ডাটাবেজের তথ্য-উপাত্তকেই ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, ভোটার তালিকার ডাটাবেজের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য নির্বাচন কমিশন কনস্ট্রাকশন অব সার্ভার স্টেশনস ফর দ্যা ইলেকটোরাল ডাটাবেজ (সিএসএসইডি) প্রকল্পের মাধ্যমে ইউএনডিপি ও সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ভৌত অবকাঠামোসহ ইলেকটোরাল ডাটা সার্ভার স্থাপন করে। সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী এ সকল ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে।

সংবিধানের কথা উল্লেখ করে ইসি চিঠিতে বলে, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ সকল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, তাদের মধ্য হতে তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজার নিয়োগসহ বিভিন্ন সমন্বয় কমিটি এবং বিশেষ কমিটির তত্বাবধানে ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে নিয়োগকৃত ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও টিম লিডারের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক ডাটা সংগ্রহ করে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। উপজেলা বা থানা পর্যায়ে এই ডাটা সংগ্রহ ও রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিবছর তথ্য সংগ্রহ করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থাকে এ ধরনের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়নি। ফলে অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থার পক্ষে সকল মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করে এ ধরনের মহা কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা সম্ভব হবে বলে প্রতীয়মান হয় না। ভোটার তালিকা বিধিমালা, ২০১২ মোতাবেক উপজেলা বা থানা নির্বাচন অফিসার রেজিস্ট্রেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৯ নং অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ সুচারু ও নির্ভুলভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার অনুদানে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রস্তুতের জন্য মাঠ পর্যায়ের সকল অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অ্যাফিস ম্যাচিং সিস্টেমসহ ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য নির্বাচন কমিশন কোনো অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেনি। এ সকল অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সংশোধন, ভোটার এলাকা পরিবর্তন, মৃত ভোটার কর্তন, ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ ইত্যাদি কাজের জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো। এগুলো ছাড়া নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। এ সকল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল ভোটার তালিকা, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন, ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কাজ করছে। এ সকল যন্ত্রপাতি নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ডাটা প্রসেসিং, ম্যাচিং এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কাগজে ছাপানো লেমিনেটেড পরিচয়পত্র তৈরি করে নির্বাচন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।

নির্বাচন কমিশন আরও বলে, পরবর্তীতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০-এর আলোকে স্থায়ী স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় আইডিয়া প্রকল্পের মাধ্যমে চিপসসহ প্লাস্টিক স্মার্টকার্ড তৈরি করে বিতরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ভোটার তালিকার তথ্য ব্যবহার করে বিদেশি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্মার্টকার্ডগুলো ছাপিয়ে সরবরাহ করেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র কয়েকটি প্রিন্টার ব্যবহার করে স্মার্টকার্ড ছাপানো হচ্ছে। এ পর্যায়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে বা প্রতিষ্ঠানের নিকট অর্পণ করা হলে নতুন করে মাঠ পর্যায় হতে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহের প্রয়োজন হবে, যা ব্যয় ও সময় সাপেক্ষ বলেও মন্ত্রিপরিষদকে দেয়া চিঠিতে জানায় ইসি।

জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা কোনো জনবল নির্বাচন কমিশনে নেই উল্লেখ করে ইসি জানায়, ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য কারিগরি জনবল ডাটা প্রসেসিং করে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সার্বিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটিশনে নিয়োজিত কর্মকর্তারা স্মার্টকার্ড প্রিন্টিংয়ের কাজ করছেন। এ সকল কর্মকর্তা ২০০৮ সাল হতে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এই দীর্ঘ ১২ বছর সময়কালে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ ও পারদর্শী করে তোলা হয়েছে। তারা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা।

জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত আলাদা কোনো জনবল না থাকায় এ সকল কার্যক্রম অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের নিকট ন্যস্ত করা হলে মাঠ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিশাল একটি জনবলের প্রয়োজন হবে যা ব্যয় সাপেক্ষ। একই সঙ্গে তারা দক্ষ এবং পারদর্শী হয়ে না উঠলে জাতীয় পরিচয়পত্রের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে বলে জানায় ইসি।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে চুক্তির অধীনে প্রায় ১৪৮টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে ইসি বলে, জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের নিকট ন্যস্ত করা হলে সেবা প্রদান বিঘ্নিত হওয়াসহ আইনানুগ জটিলতার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন থেকে আলাদা করার লক্ষ্যে ২০০৯-২০১০ সালেও একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এ লক্ষ্যে একটি সংস্থা কাজ শুরু করলেও উপরে বর্ণিত কারণ সমূহের জন্য তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ফলে তা নির্বাচন কমিশনের নিকট থেকে যায়। পরবর্তীতে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন ২০১০-এর মাধ্যমে এর কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের নিকট ন্যস্ত করা হয়।

কমিশন আরও বলে, এসব বিষয় জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবস্থাপনায় যেকোনো পরিবর্তন আনার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। এ সকল বিষয় বিবেচনায় আনা হলে জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যক্রম ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রাখা সমীচীন হবে বলে কমিশন মনে করে।

উল্লেখ্য, গত ১৭ মে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম ইসির পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বরাবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই চিঠির প্রেক্ষিতে ২৪ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ইসি সচিব ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে এই বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এসব চিঠির প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এই চিঠি দিল কমিশন।

শেয়ার করুন