মানুষের অন্তর্গত মনুষ্যত্ব রক্ষা করা জরুরি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মানবিক সম্পর্কগুলোর ভেতর বড় জায়গা দখল করে থাকে বৈবাহিক সম্পর্ক। ধর্ষণ বিয়ের ভেতরে চলে, বাইরেও চলে। কারণ সমাজ পুরুষশাসিত; এমনকি বাহ্যত অত্যন্ত পরহেজগার বলে পরিচিত মানুষের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। যেমন হেফাজতে ইসলামের নেতারা; তাঁরা শুধু ধার্মিকই নন, পূতপবিত্রতায় তাঁরা আদর্শস্থানীয় হওয়ারও দাবিদার। তাঁদের নতুন এক নেতা দেখা দিয়েছেন, মামুনুল হক নাম। তাঁর ভঙ্গি, বচন, কণ্ঠস্বর—সবই ঘোষণা করছিল, যেকোনো মুহূর্তে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তিনি প্রস্তুত রয়েছেন—হয় শহীদ, নয়তো গাজি হবেন। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ একটি ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে শুনে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে স্থাপনাটি করা হলে ওটিকে নিজ হাতে ভেঙে নদীতে নিক্ষেপ করবেন। শুধু ওই ভাস্কর্য নয়, বাংলাদেশকেই ভাস্কর্যশূন্য করে পুণ্যভূমিতে পরিণত করে তবে ছাড়বেন। এবং লক্ষ্য ওইখানে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বাংলাদেশে তাঁরা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন, যদিও তাঁরা এবং তাঁদের পূর্বসূরিরা এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়ে শুধু যে বিরোধিতা করেছেন তা নয়, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের প্রাণ হরণ পর্যন্ত করেছেন স্বহস্তে। সাত বছর আগে শাপলা চত্বর দখল করার সময়ে হেফাজত যে ১৩ দফা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল সেগুলো পড়লে সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষের গা শিউরে উঠবে। হেফাজতের নবীন নেতা ঘটনাক্রমে জনতার হাতে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন এক মহিলাকে নিয়ে বিনোদনকেন্দ্রে ‘বিশ্রামরত’ অবস্থায়। ধরা পড়ে মোটেই অপ্রস্তুত হননি, তেমন বান্দা আদপেই নন; বলেছেন মহিলা তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের ‘হালাল’ স্ত্রী। পরে জানা গেছে, হালাল বলে কথিত বন্ধনে যুক্ত মহিলাকে তিনি আসলে বিয়ে করেননি; মহিলা থানায় অভিযোগ করেছেন যে মামুনুলের দ্বারা তিনি প্রথমে বিয়েবিচ্ছেদে প্ররোচিত ও পরে ধর্ষিত হয়েছেন। হেফাজতের অপর এক জাঁদরেল নেতা, যিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধেও একজন মহিলা ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। এই ব্যক্তিগুলো আবার মাদরাসার শিক্ষক হিসেবেও যশস্বী। কী শিক্ষা দিয়েছেন এতকাল ধরে আমরা জানি না, তবে ভাবতে যে ভয় লাগে সেটা টের পাই।

ভালোবাসার সম্পর্ক ভেঙে পড়ার খুব বড় একটা দৃষ্টান্ত বিল গেটসের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডার বিয়েবিচ্ছেদ। ২৭ বছরের বৈবাহিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আইনি ঘোষণা জারি করেছেন। সারা বিশ্বে তা প্রচার পেয়েছে। কারণ বিল গেটসদের বিশ্বখ্যাতি। অনেকেরই ধারণা ছিল, তাঁরা একটি অনুকরণীয় দম্পতি। বিয়েবিচ্ছেদের ঘোষণায় তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার অভিযোগ আনেননি। নিজেদের তিনটি সন্তানকে তাঁরা ইংরেজিতে বলেছেন ‘ইনক্রেডিবল’। নিজেদের জনকল্যাণমূলক ফাউন্ডেশনের বিষয়ে অঙ্গীকার করেছেন যে ওই কাজটির সঙ্গে তাঁরা যুক্ত থাকবেন। যুক্তবার্তাটি তাঁরা শেষ করেছেন এই আশা ব্যক্ত করে যে নতুন জীবনে তাঁরা নিভৃতি পাবেন।

কিন্তু সম্পর্কের ওই মৃত্যুটা ঘটল কেন? এ নিয়ে গবেষণা, তথ্যানুসন্ধান ইত্যাদি ঘটবে নিশ্চয়ই। যে নিভৃতি তাঁরা চেয়েছেন অনেকের উঁকিঝুঁকিতে তা বিঘ্নিত হবে এমন আশঙ্কা রয়েছে; কিন্তু বাইরে থেকে আমরা বুঝতে পারি যে তাঁদের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য দেখা দিয়েছিল। মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ বিল গেটসদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এসেছিলেন একজন কর্মী হিসেবে; সে অবস্থায়ই দুজনের জানাশোনা। তারপর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং বিয়ে করেছেন। বিয়ের আগে জানাশোনা, ওঠাবসা সাত বছরের, ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই একটা খরা দেখা দিয়েছিল। খরা সাধারণত অভাবের কারণেই ঘটে থাকে, তবে আবার প্রাচুর্যের কারণেও যে ঘটে না, তা নয়। গণমাধ্যমকর্মীরা উল্লেখ করেছেন যে বিল গেটসদের ভাঙনের দুই বছর আগে আরেকটি শীর্ষ ধনী দম্পতির বিয়েও ভেঙে গেছে। তাঁরা হলেন অ্যামাজন কম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁর স্ত্রী। বিল গেটসরা যা জানিয়েছেন সেটা হলো, তাঁরা একটি নতুন জীবন শুরু করতে চাইছেন, যে জীবনে তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গী হতে পারবেন না। এমনটা যে ঘটতে পারে তার একটা আভাসের কথা অবশ্য পাওয়া গেছে মেলিন্ডার একটি উক্তি থেকে। সেটা হলো, বিয়ের পর তিনি দেখতে পেয়েছেন যে বিল বিয়ের আগে তাঁর অভ্যাসমাফিক একটি বোর্ডে লিখে হিসাব করেছিলেন তাঁদের বিয়ের সম্ভাব্য ভালো-মন্দ দিক নিয়ে। যেন লাভ-লোকসানের হিসাব। ওই হিসাবজ্ঞানটা নিশ্চয়ই তাঁর বেশ প্রখর ছিল, নইলে অতটা উঠলেন কী করে। এখন যখন তাঁদের জীবনের একটা নতুন পর্যায় শুরু হতে যাচ্ছে, বিলের বয়স ৬৫ বৈ নয়, তখন আবারও ওই হিসাবটা এসেছে নিশ্চয়ই। এবং বিদ্যমান সম্পর্কটিতে লাভের সম্ভাবনা কম দেখেই হয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। বাইরের লোকের পক্ষে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। তবে এটা তো আমরা জানি যে বিল গেটস অত্যন্ত মেধাবান ও সৃষ্টিশীল একজন মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন এবং বলেছেনও যে ‘উদ্ভাবনই হচ্ছে প্রগতির চালিকাশক্তি’। অবশ্য নিজে তিনি যা উদ্ভাবন করেছেন তা যন্ত্রই। যন্ত্র যতই উৎপাদনশীল হোক, সে তো যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নয়। মানুষের পক্ষ নিয়ে সে কাজ করে, মানুষের শ্রম লাঘব করে দেয়। কিন্তু নিজের যন্ত্রত্ব সে খোয়ায় না, যন্ত্রই রয়ে যায়। বিশ্বে এখন রব উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের। শিল্প বিপ্লবের এই সর্বাধুনিক পর্যায়ে মানুষ তার স্বাভাবিক বুদ্ধির কার্যকারিতা আরো কমিয়ে আনবে। বিল গেটস কি সেই নতুন যুগের কথাই ভাবছেন? না ভাবলেও সে যুগের আগাম ছায়া হয়তো তাঁর উদ্ভাবনশীল জীবনের ওপর এসে পড়েছে। এই জীবনে আবেগ ও নৈতিকতার স্থান আরো সংকুচিত হবে। সেখানে বদান্যতা থাকতে পারে; কিন্তু সেটা হবে কৃত্রিম। তার পেছনে তাগিদ থাকবে না প্রাণের। আগামী দিনে তো মনে হয় সব কিছুই জানা হয়ে যাবে, রহস্যময়তা খুঁজে পাওয়াটা ভার হবে। অনেক কিছুর মতো তাতে বিপন্ন হবে দাম্পত্যজীবনও। কারণ দাম্পত্যজীবনে যদি রহস্য না থাকে, না থাকে প্রাণবন্ততা, একে অপরকে নিত্যনতুনভাবে আবিষ্কারের সুযোগ, স্বামী-স্ত্রী যদি পরস্পরকে যন্ত্রের মতো জেনে ফেলেন, তাহলে দুটি যন্ত্র একসঙ্গে থাকবে কী করে? থাকলেও ঠোকাঠুকিটা অনিবার্য। সেটাই কি ঘটেছে বিশ্ববিখ্যাত এই দম্পতির জীবনে?

না, আমরা জানি না। তবে এটা জানি যে এই আধুনিককালে (অর্থাৎ পুঁজিবাদের চরম উন্নতি ও দুঃশাসনের সময়ে) মানবিক সম্পর্কগুলো যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। বিবাহ এককালে যে চরিতার্থতা দিত, অথবা দিচ্ছিল বলে মনে করা হতো, এখন দেখা যাচ্ছে তা আর দিচ্ছে না। এখন লাভ-লোকসানের হিসাবটা বেশ বড় আকারে এসে গেছে। বুদ্ধি বড় হয়ে উঠেছে হৃদয়ের চেয়ে। কিন্তু আগামী দিনে বুদ্ধি কি আর বড় হতে পারবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায়ই যখন কাজ চলবে? বুদ্ধি নিশ্চয়ই থাকবে, বুদ্ধি না থাকলে মানুষ আবার মানুষ কিসে? কিন্তু ওই বুদ্ধি হৃদয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সে হবে কূটবুদ্ধি। শুধুই মুনাফা খুঁজবে। আবেগ, নৈতিকতা, অন্যের জন্য বিবেচনা—এসবকে সে বাহুল্য জ্ঞান করবে। একসময় মনে করা হতো যে মানুষের মাথাটা ক্রমাগত বড় হতে থাকবে, হাতের তুলনায়; কারণ হাতের কাজের চেয়ে বুদ্ধির কাজ বড় হচ্ছিল। তা বুদ্ধির কাজ ঠিকই বেড়েছে; কিন্তু বাড়তে বাড়তে সে স্বার্থবৃদ্ধির কুটিল ক্ষমতাদানের কৌশলদাতায় পরিণত হয়েছে এবং এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি করতে চলেছে।

আমরা অবশ্যই আশা করব এই অগ্রগতিটা থামবে। মানুষ তার অন্তর্গত ও অপরিহার্য মনুষ্যত্বকে রক্ষা করবে বুদ্ধি খাটিয়ে এবং হৃদয়ের অনুশাসন মেনে। এ ক্ষেত্রে বিল গেটসের মতো উদ্ভাবনশীল মানুষ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন। কারণ এটা তো সত্য, পৃথিবী যে গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছে, বিল গেটসের সেটা অজানা নয়। তাঁর বদান্যতায় প্রতিষ্ঠানগুলো ওই উপলব্ধি থেকেই সৃষ্টি। এরই মধ্যে শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি তিন তিনটি বই লিখেছেন এবং একটি বইয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে How to Avoid a Climate Disaster। ব্যক্তিগত এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি ও তাঁর মতো মেধাবান মানুষ নিশ্চয়ই পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করতে চাইবেন।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন