কয়েক দিন পরই মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের ছয় মাস পূর্ণ হবে। এই সময়ের মধ্যে চরম সংঘাত প্রত্যক্ষ করেছে মিয়ানমারবাসী। সেনা অভ্যুত্থানের পরে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মুখে মিয়ানমারে ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। বৃহস্পতিবার ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দ্য কো–অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের (ওসিএইচএ) এক প্রতিবেদনে তথ্য জানানো হয়েছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা জানিয়েছে, সংঘাতের মুখে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত মানুষের বড় পরিসরে জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। খাবার, আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন প্রাপ্তির সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। মানসিক ধাক্কা সামলানোর জন্য তাদের সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে, এমনটাই মনে করছে ওসিএইচএ।
সংস্থাটি জানিয়েছে, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুতদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ অপ্রতুল। রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক জায়গায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
থাইল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের কারেন রাজ্য। আগে থেকেই স্থানীয় স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের বিরোধ ছিল। সেনা অভ্যুত্থানের পরে তা রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এ রাজ্যে জান্তা সেনা-পুলিশের ওপর হামলার খবর হরহামেশাই পাওয়া যায়। সেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। এসব সংঘাতের জের ধরে কারেন রাজ্য থেকে ১ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে ওসিএইচএ। গত মাসে এ রাজ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার মানুষ। কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) মিয়ানমারের অন্যতম বৃহত্তম সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন।
একইভাবে ভারতের সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের প্রত্যন্ত রাজ্য শিন থেকেও বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর উত্তরাঞ্চলীয় কাচিন ও শান রাজ্যের হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয় অং সান সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওই নির্বাচনকে ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ বললেও জনতার রায় মানেনি দেশটির সেনাবাহিনী। ১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। আটক করা হয় সু চিসহ মিয়ানমারের প্রভাবশালী গণতন্ত্রকামী নেতাদের। ঘুষ নেওয়া, তথ্য গোপন আইন ভঙ্গসহ একাধিক অভিযোগে এখন সু চির বিচার চলছে।
তবে মিয়ানমারের জনতা সেনা অভ্যুত্থান মেনে নেয়নি। সু চির মুক্তি ও সেনাশাসনের অবসানের দাবিতে কয়েক মাস ধরে উত্তাল রয়েছে মিয়ানমারের রাজপথ। চলছে বিক্ষোভ। সঙ্গে সেনাদের দমনপীড়ন। এখন পর্যন্ত সেনা-পুলিশের গুলিতে মিয়ানমারে অন্তত ৮৭৭ জন বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে অধিকার সংগঠন অ্যাসিস্টেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি)। আটক হয়েছেন সাংবাদিকসহ কয়েক হাজার মানুষ। জান্তার শাসন হটাতে মিয়ানমারে ‘ছায়া সরকার’ গঠন করেছে ক্ষমতাচ্যুত রাজনীতিকেরা।
নিজ দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে দমনপীড়নের জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও সেনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরও কমেনি জান্তার দমনপীড়ন। পাল্টা-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন সেনাশাসনের বিরোধীরা। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এদিকে চলমান অচলাবস্থা নিরসনে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে আসিয়ান। এ জন্য আঞ্চলিক সংস্থাটির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা সফর করেছিলেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। আসিয়ানের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল পাঠানোর কথা রয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। এর মাঝেই গত সপ্তাহে মিয়ানমারে রক্তপাতের নিন্দা প্রকাশ করে ও দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। এ প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল।