হলি আর্টিজানে হামলা: করোনায় আটকে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

হলি আর্টিজান হামলা
হলি আর্টিজান হামলা। ফাইল ছবি

রাজধানীর গুলশানের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান-২ এর ৭৯ নাম্বার সড়কের শেষ প্রান্তে লেক পাড়ের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন ও ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞে দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। এছাড়া কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ আরও ২০ জনকে। সেদিন রাত ৮টা ৫০মিনিট থেকে ১২ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস এক জঙ্গি হামলার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছিল গোটা জাতি।

নৃশংতম এই হামলার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলও এখনও মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এজন্য করোনাভাইরাস মহামারীকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ বছরই শুনানির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন তিনি।

২০১৬ সালের জুলাইয়ের ১ তারিখে অভিজাত বেকারিটিতে বিপথগামী কয়েকজন তরুণের আত্মঘাতী হামলায় অনেকটাই বদলে দেয় বাংলাদেশকে। পাঁচ বছর আগে সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়া ওই ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না বাংলাদেশ।

তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

এই ঘটনার পর শুধু র‌্যাবের অভিযানেই ধরা পড়েছে প্রায় ১৫শ’ জঙ্গি সদস্য। গত মঙ্গলবার বাহিনী প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলা পরবর্তী সময়ে র‌্যাবের অভিযানে এক হাজার ৪১৬ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়।’ এছাড়া অনান্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আরো জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করেছে।

সেই রাতে কী ঘটেছিল?

সন্ধ্যারাতে হঠাৎ করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে গুলশানে ‘সন্ত্রাসীদের সঙ্গে’ পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে। এর আগে ৫ জঙ্গি দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বসুন্ধরার বাসা থেকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার উদ্দেশে রওনা হয়।

২০১৬ সালের ১ জুলাই বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে কাঁধে থাকা ব্যাগে অস্ত্র-গুলি, গ্রেনেড, চাকু নিয়ে বের হয়ে রাত ৮টা ৪২ মিনিটের দিকে সেখানে পৌঁছে কয়েকজন বিপথগামী তরুণ। প্রথমে নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ মোবাশ্বের এবং একটু পর রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম বাঁধন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হলি আর্টিজানের মূল ফটকে যায়।

তখন ফটকের নিরাপত্তাকর্মী নূর ইসলাম তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে নিবরাস নিরাপত্তাকর্মীর ডান চোখের নিচে ঘুষি মারে। এরপরই পাঁচ জঙ্গি হলি আর্টিজানের ভেতর ঢুকে যায়। ঢুকেই গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভেতরে থাকা সবাইকে জিম্মি করে। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায়। ঢাকার গুলশানে জঙ্গি হামলা হয়েছে মুহুর্তের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো তা প্রচার করতে থাকে। আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করে গোটা দেশ।

আধা ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচ জঙ্গির কাছে থাকা অস্ত্র-গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে দেশি-বিদেশিদের হত্যা করে। বিভিন্ন রুম, টয়লেট, চুলার ঘর, হিমঘর ইত্যাদি স্থান থেকে বিদেশিদের বের করে এনে তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। একপর্যায়ে তারা দেশি-বিদেশিদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

রাত ১০টার দিকে র‌্যাব, পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কয়েকশো সদস্য ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয়।

জঙ্গিদের নির্মূলে অভিযান শুরু যেভাবে

হামলার পরের দিন সকাল ৭টা ৩০ মিনিট: রাতভর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর যৌথ সেনা, নৌ, পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘থান্ডার বোল্ট’।

৭টা ৪৫ মিনিট: কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দলের সদস্যরা প্যারা কমান্ডো সদস্যরা ক্রলিং করতে করতে সামনে দিকে এগোতে থাকে এবং গুলি ছুড়তে থাকে পদাতিক ডিভিশন ও স্লাইপার টিম। এসময় জঙ্গিরাও গুলি ছুড়তে থাকে।

সকাল সোয়া ৮টায় রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। পাশের একটি ভবন থেকে একজন বিদেশি নাগরিক তার মোবাইল ফোনে সেটি ধারণ করেন।

৮টা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা।

৯টা ১৫ মিনিটে অভিযান শেষ হয়। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়।

সকাল ১০টায় ৪ জন বিদেশিসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত পাঁচজনের মৃতদেহ পাবার কথা পুলিশ জানায়।

মামলার বিচারকাজ

এ ঘটনায় গুলশান থানার মামলা হয়। মামলাটি তদন্ত করে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। এই হামলায় মোট ২১ জনের সম্পৃক্ততা পায় তদন্ত সংস্থাটি। এর মধ্যে পাঁচ জঙ্গি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এছাড়া পুলিশ ও র‌্যাবের বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয় আরও আট জন। জীবিত বাকি আটজনকে আসামি করে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

সিটিটিসির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ঘটনার প্রায় দেড় বছর আগে পরিকল্পনা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে নৃশংস এ হামলা সরাসরি বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেওয়া হয় আত্মঘাতি পাঁচ জঙ্গিকে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে জেএমবির একটি গ্রুপ বিদেশিদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

পরবর্তীতে ‘নব্য জেএমবি’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ গ্রুপটির কথিত শুরা কমিটি গাইবান্ধার সাঘাটায় বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নেয়।

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি

দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার পর বিচারিক কার্য্ক্রম শুরুর এক বছরের মধ্যেই আদালত মামলার রায় ঘোষণা করে। রায়ে মামলার ৮ আসামির ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়।

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন।

তাছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। তবে রাষ্ট্রপক্ষ সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। কিন্তু গত ১৭ মাসে কোনও আপিলেরই শুনানি হয়নি।

মহামারীতে আটকে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি

নজিরবিহীন এই হামলার পঞ্চমবার্ষিকীর আগের দিন বুধবার অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ বছরই শুনানির জন্য ‘সর্বোচ্চ’ চেষ্টা চালাবেন তিনি।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে আছে। মামলার পেপারবুক রেডি হয়ে গেছে। যেহেতু এটি ডেথ রেফারেন্সের মামলা। ডেথ রেফারেন্সের মামলাগুলো তালিকা অনুযায়ী শুনানির জন্য আসে।’

‘আপনারা জানেন কোভিডের কারণে গত বছর মার্চের পর থেকে স্বাভাবিক আদালত হচ্ছে না। সেই কারণে মামলাগুলো শুনানির জন্য উঠতে দেরি হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি মামলাটি মেনশন করব। এ বছরের মধ্যে মামলাটি শুনানি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’

কর্মসূচি
হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর প্লটের ওই বাড়িটি নিহতদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য খুলে দেওয়া হবে।

করোনা মহামারির কারণে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও সীমিত পরিসরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি নাগরিকদের জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সেখানে বেশি মানুষ ভিড় করতে পারবেন না।

শেয়ার করুন