করোনা মহামারির মধ্যে দেশের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের সংকট, স্বাস্থ্যখাতে নানান অনিয়ম এবং সংসদে দেয়া বক্তব্যের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে তুলোধুনো করেছেন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। এ সময় তাঁর পদত্যাগও দাবি করেন বিরোধী দলের সাংসদরা।
শনিবার সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিরোধী দলের সাংসদরা। তবে এ সময় মন্ত্রী জাহিদ মালেক অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না।
বিএনপির সাংসদ জি এম সিরাজ তার বক্তব্যে বলেন, বগুড়া কোভিডের হটস্পট। গত তিন দিনে বগুড়ায় মৃতের সংখ্যা ২৪ জন। মৃত্যুর কারণ হলো উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই ফ্লো নেইজাল ক্যানুলার সংকট। আজকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। থাকলে ভালো হতো।
সাংসদ সিরাজ তার নির্বাচনী এলাকায় ২০টি করে হাই ফ্লো নেইজাল ক্যানুলা সরবরাহ এবং সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের দাবি জানান।
এখান থেকেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর একেএকে জাতীয় পার্টির একেকজন সাংসদ তাদের ক্ষোপ প্রকাশ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিষয়ে।
গত ৩০ জুন সংসদে বাজেট পাসের সময় বিরোধী সংসদ সদস্যদের সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি সেদিন আইনপ্রণেতাদের ওপর দোষ চাপিয়েছিলেন। সব বিষয় তুলে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘মাস্ক নিয়ে কথা হলো। সেদিন আমি এখানে বলেছিলাম, মন্ত্রীকে ডিরেক্ট বলিনি। বলেছিলাম চার টাকার মাস্ক ৩৫৬ টাকায় কেন কেনা হলো? উনি তদন্ত করবেন, দেখবেন, ব্যবস্থা নেবেন। এই হলো মন্ত্রীর দায়িত্ব। তিনি সেটা এড়িয়ে বললেন, এটা সত্য না। আমি তথ্য-প্রমাণ নিয়ে এসেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। দুদকে চলে গেছে। পত্রিকায় এসেছে। ওনাদের একটি প্রকল্পের পিডি স্বীকার করেছে। উনি বলেছেন, উনি ওইসময় ছিলেন না। উনি কী করবেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রী এড়িয়ে না গিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতেন। ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নিতে হবে।’
জাতীয় পার্টি আরেকজন এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ সাতক্ষীরার হাসতাপালগুলোর চিত্র তুলে ধরে বলেন, বেদনাদায়ক বিষয়। সাতক্ষীরায় হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে সাতজন কোভিড রোগী এক ঘণ্টার মধ্যে ছটফট করতে করতে মারা গেছে। এই সাতক্ষীরা হলো এর আগে যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন রুহুল হক সাহেবের এলাকা। এইখানে তো ফাইভস্টার হাসপাতাল হওয়া উচিত। অক্সিজেনের অভাবে কীভাবে রোগী মারা যান বুঝি না। মন্ত্রীরা যান আসেন, নিজের এলাকাডাও ঠিক রাখতে পারেন না?
ফিরোজ বলেন, অক্সিজেন প্ল্যান্ট করা অত্যন্ত সেনসিটিভ কাজ। সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা প্রপার ডিজাইন করে অক্সিজেন প্ল্যাট বসাতে হয়। অক্সিজেন সাপ্লাই লাইনে প্রোপার ডাইমেনশন থাকতে হবে। এখানে যদি কোনো লিকেজ থাকে তাহলে আগুন ধরে যাবে। মন্ত্রী সাহেব ভালো করে জানেন। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেল। ঠিক আছে, আপনি ম্যানুয়াল করতেন। সিলিন্ডার মুখে দিলে জীবনটা তো বাঁচত কিছুক্ষণের জন্য। পারলেন না। নার্স-ওয়ার্ড বয়-ডাক্তার কী কাজ করলো দেখবেন না আপনি? আমরা তো রোগী আইসিইউতে ঢুকায়ে দেই। যাওয়ার পর কী চিকিৎসা হয় কেউ খবর রাখে না। ওইখানে অধিকাংশ রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। বলে যে রোগীর অবস্থা খারাপ। ভেন্টিলেশন দিচ্ছি। এক ঘণ্টার পর বলে রোগী মারা গেছে নিয়ে যান। কোনো চিকিৎসা হয় না।
জাতীয় পার্টি এমপি মুজিবুল হক চুন্নু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, গত দুই দিন আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পার্লামেন্টের মতো জায়গায় বলে গেলেন, আমরিকার সঙ্গে তুলনা করলেন। আমেরিকাতেও মানুষ মারা যায়। আমাদের এখানে অনেক মানুষ কম মারা যায়। মনে হইল যেন ওইটা উনার ক্রেডিট। উনার কারণেই বাংলাদেশে মানুষ মারা যায়নি।’ হাসপাতালে পাঁচজন রোগী অক্সিজেন পায় তো আরও ২০ জন লাইনে থাকে। স্বাস্থ্যখাতের এমন দুর্বস্থার কথা তুলে ধরে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন এক বছরে নাকি অনেক কাজ করেছেন। আজকের খবর আসছে বাংলাদেশের ৩৭টি জেলায় অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে পাঁচজন রোগী অক্সিজেন পায় তো ২০ জন লাইনে থাকে। কেবলমাত্র অক্সিজেনের কারণে যারা ছটফট করে মারা যাচ্ছেন। পত্রিকায় এত লেখালেখি হচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি একটি হাসপাতালে গিয়ে এগুলো দেখেছেন। তিনি কী করেন? তিনি জুম মিটিং করেন।
নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের প্রসঙ্গ ধরে চুন্নু বলেন, ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে একটি কিস করার কারণে তাকে রিজাইন দিতে হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী মানুষ? বুঝলাম না। উনার লজ্জা-শরম কিছু নাই। চরিত্র নেই। ওনার রিজাইন দেওয়া উচিৎ।
বিএনপির হারুনুর রশীদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, উনি বলেছেন, আপনারা (এমপি) তো হাসপাতালের চেয়ার। মেশিন চলে না, লোক লাগবে এগুলো তো আপনাদেরকে দেখতে হবে। কিন্তু আপনারা তো দেখেন না। উনার বক্তবে মনে হচ্ছে, কোনো এমপিই দায়িত্ব পালন করেন না। এই বক্তব্য আপত্তিজনক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী গোটা হাউসকে অপমান করেছেন। তার বক্তব্য এক্সপাঞ্জ হওয়া দরকার।