মানুষের পাশে দাঁড়ানোই এখন প্রধান নৈতিক দায়িত্ব

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন নারায়ণগঞ্জে একটি ফ্রুট জুস কারখানায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই শিশু। এই শিশুদের অনেকেই স্কুলে লেখাপড়া করত। করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় এখানে কাজ করতে এসেছিল। এরা আর কখনো স্কুলে ফিরবে না। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। এর জন্য আইনও আছে। শিশুশ্রম আইন মানা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য সরকারের অধিদপ্তর আছে, পরিদর্শক আছেন। যে ভবনে এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটেছে তা গোডাউন হিসেবে চিহ্নিত। জানা গেছে, ঘটনার সময় ওই ভবন থেকে বের হওয়ার সব দরজা বন্ধ ছিল। মানে এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এই দুর্ঘটনা ২০১২ সালের আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়, যেখানে আগুনে পুড়ে ১১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক কারখানায় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকাটা বাধ্যতামূলক। যারা এ ধরনের কারখানায় কাজ করে, তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এসব দেখার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা তাঁদের কাজ সঠিকভাবে করলে এ রকম ট্র্যাজেডি হয়তো ঘটত না। আসলে সরকারের অনেক কর্মচারী তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন না। তাঁদের কেউ ছোট আমলা, কেউ বা বড়। দেশ এখন অসৎ আমলাদের হাতে চলে গেছে। এই নিয়ে সংসদেও আলোচনা হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম হয়তো আছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুজিববর্ষে প্রত্যেক গৃহহীনকে একটি করে ঘর দেওয়া হবে। তার জন্য আশ্রয়ণ বলে একটি প্রকল্প তৈরি করা হলো। দায়িত্বে ছিলেন বড় আমলারা। প্রথম ধাপে ৭০টি পরিবারকে বাড়ি হস্তান্তর করলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। এটি একটি বিস্ময়কর কর্মযজ্ঞ, যা সম্ভব হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টির কারণে। এই ঘটনা দেশে-বিদেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে, প্রশংসিত হয়। কিছুদিন যেতেই দেখা গেল অনেক বাড়িতে নির্মাণ ত্রুটির কারণে ফাটল ধরেছে অথবা তা সম্পূর্ণ ধসে গেছে। দ্বিতীয় দফায় গত মাসে প্রধানমন্ত্রী আরো ২০ হাজার পরিবারকে বিনা মূল্যে বাড়ি দিলেন। প্রকল্প প্রস্তুত করলেন যথারীতি বড় আমলারা। আর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেলেন ছোট আমলারা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা গেল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশের ২২টি জেলায় নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটার পর একটা বাড়ি ধসে পড়ছে। অনেক স্থানে বেশির ভাগ বাড়ি পানিতে ডুবে গেল। সঙ্গে ধসে গেল বেশির ভাগ বাড়ির দেয়াল। এতে সরকারের তো বটেই, বদনাম হলো প্রধানমন্ত্রীর আর দেশের। প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হলেন, বলা হলো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এই মহা কেলেঙ্কারির তদন্ত হবে এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হবে। বাস্তবে তেমনটি ঘটবে তা খুব বেশি মানুষ বিশ্বাস করে না। কারণ এর চেয়েও বড় বড় কেলেঙ্কারির পরও অনেকে অতীতে শাস্তি পাননি। সংশ্লিষ্ট আমলারা তো ননই। আবার অন্যদিকে অনেকেই পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেকে তাঁদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে দিলেন। পরে নিজেও দেশত্যাগ করলেন। কয়েক দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে গত ১৬ বছরে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ১১ লাখ কোটি টাকা, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাচার করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। এই সময় দেশে তিনটি সরকার ক্ষমতায় ছিল। বিএনপি, ১/১১ আর বর্তমান সরকার। এই যে প্রধানমন্ত্রীর অনেক স্বপ্নের প্রকল্প ধসে গেল। বলার অপেক্ষা রাখে না, দুর্নীতি আর অদক্ষতা একটি বড় কারণ। অন্যদিকে সরকারের বিরোধী পক্ষের শিবিরে এখন ঈদের আনন্দ। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বললেন, যে বাজেট দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে এর চেয়ে ভালো বাড়ি বানানো যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথমে কেন এই তথ্যটি জানা সত্ত্বেও বাড়ি বানানোর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেওয়া হলো। যদি বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য কাজটি করা হয়েছে, তা হলে কি তা অসত্য হবে? একটি কথা প্রচলিত আছে, যেসব দেশে আমলাতন্ত্র খুব শক্তিশালী, সেসব দেশের আমলারা পরবর্তী সরকারের জন্য কাজ করে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।

এখন একটু আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে নির্মিত বাড়িগুলোর নির্মাণপ্রক্রিয়া নিয়ে দুটি কথা বলি। দেখে মনে হচ্ছে এই বাড়িগুলো পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের গাঁথুনি দিয়ে তার ওপর নির্মিত। নির্মাণ প্রকৌশলীদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, একটি ইটের ভবনের ২৫ শতাংশ স্থায়িত্ব নির্ভর করে ব্যবহৃত ইটের মান ও তার কিউরিংয়ের ওপর। কিউরিং খুবই সহজ। ইট গাঁথুনিতে ব্যবহারের আগে তা যথেষ্ট সময় ধরে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের গাঁথুনি হলে সিমেন্ট ও বালুর অনুপাত হবে এক বস্তা সিমেন্টের সঙ্গে চার-পাঁচ বস্তা বালুর মিশ্রণ। বালু লবণমুক্ত হতে হবে। যে ধরনের বাড়ি আশ্রয়ণের জন্য নির্মিত হয়েছে তা একতলা। এসব বাড়ির চার কোনায় হয় রডের অথবা ইটের ১০ ইঞ্চি পিলার থাকতে হবে। যে পানি ব্যবহার করা হয়, তা যেন নোংরা উৎস থেকে না হয়। আশ্রয়ণের বাড়িগুলো কি এসব শর্ত মেনে নির্মাণ করা হয়েছিল? তার জবাব কি কখনো পাওয়া যাবে? অতীত অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর নয়। এমনও হতে পারে যাঁরা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাঁরা নানাভাবে পুরস্কৃত হবেন, কারণ যাঁরা পুরস্কৃত করবেন তাঁরা সমগোত্রীয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা সাধারণ মানুষের। অন্য কারো ওপর কি আছে? ‘না নেই’। সার্বিক অবস্থায় এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এই মুহূর্তে বলা চলে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। উদাহরণের অভাব নেই।

সব শেষে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দুটি কথা। গত ১৬ মাসে বাংলাদেশ করোনায় বিপর্যস্ত। গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। পরীক্ষা বাড়ালে সংক্রমিতের সংখ্যা আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। সরকার নানা নামে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে। কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হচ্ছে। এখন অনেক শহরে লকডাউনের বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভ করছে, আর এর পেছনে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ইন্ধনও জোগাচ্ছে। তবে যারা বিক্ষোভ করছে, তাদেরও যুক্তি আছে। তারা দেখছে এক শ্রেণির মানুষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছে। নিজেদের ব্যবসা নানা অজুহাতে খোলা রাখছে। অন্যদিকে যারা দিন আনে দিন খায় অনেক সময় পরিবারের অন্ন জোটানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় সরকার তাদের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তা সব সময় সুপরিকল্পিতভাবে করা হয় না। পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আগে শুধু নিম্নবিত্তদের সহায়তা দিলেই হবে না, তা হতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে; আর এ ধরনের সহায়তার জন্য শুধু সরকারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁদেরও এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, এখন সহায়তা অনেক মধ্যবিত্তেরও প্রয়োজন। কোনো মানুষ যেন অভুক্ত না থাকে, এটা নিশ্চিত করতে হবে।

সামনে একটি ঈদ আসছে। এই ঈদেও কয়েক লাখ মানুষ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানুষকে সচেতন করে তা যদি ঠেকানো না যায়, তাহলে এর পরে যে বিপর্যয় আসবে তা আরো ভয়াবহ হতে পারে। এই কঠিন সময়ে যাঁরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আছেন, তাঁদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ সার্বিক বিচারে তাঁদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে অক্ষম, এটি এখন উপলব্ধি করার সময় হয়েছে। তাঁদের বিদায় করে তাঁদের স্থানে যোগ্য মানুষ নিয়োগ করা এখন সময়ের দাবি। জানি এই লেখা পড়ে কেউ কেউ মনঃক্ষুণ্ন হবেন, তবে সত্যটা বলার এখন সময় হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের ঘর দিয়েছেন। দেশের স্বার্থে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই এখন সব দেশদরদি মানুষের প্রধান নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন