বাংলাদেশের জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে। খবরটা হলো, আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও ব্রিটেন দ্রুত তাদের সেনা সরাচ্ছে। অন্যদিকে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তালেবান তাদের চুক্তি অনুযায়ী খুব দ্রুত দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ দখল করে নিয়েছে বলে দাবি জানিয়েছে। অধিকৃত এলাকাগুলোতে নারীদের বাধ্যতামূলকভাবে ঘরে অবস্থান, বোরকা পরিধান, চাকরি ত্যাগ এবং মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মুরতাদ, কাফের ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে বিনা বিচারে অবাধে হত্যাকাণ্ড চলছে।
সহৃদয় পাঠক, আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে আফগানিস্তান। সেখানে কিছুকাল আগেও তালেবান রাজত্ব ছিল। তখনো কম হত্যাকাণ্ড সেখানে হয়নি। তখন বাংলাদেশের কোনো বিপদ না হয়ে থাকলে এখন হবে কেন?
এই ধরনের প্রশ্ন যাঁরা করেন অথবা করবেন, তাঁদের সাম্প্রতিক অতীতের দিকে একটু দৃষ্টি ফেরাতে বলি। আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিক নজিবুল্লাহ সরকারকে ‘রাশিয়ার তাঁবেদার’ আখ্যা দিয়ে উচ্ছেদের জন্য আমেরিকা পাকিস্তানের পেশোয়ারে বিরাট সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। এখান থেকে ইসলামের নামে জিহাদ করতে তালেবান, মুজাহিদীন, হিজবুল্লাহ ইত্যাদি সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী গড়ে তোলে।
আমেরিকান অস্ত্র ও সেনাদের সাহায্যে আফগানিস্তানে নজিবুল্লাহ সরকারকে উত্খাত করা হয়। নজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর কিছুদিন চলে জঙ্গি গ্রুপগুলোর মধ্যে নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমেরিকার সাহায্য ও সমর্থনে তালেবান রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আমেরিকা প্রতিবছর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে এই তালেবান সরকারকে কাবুলে টিকিয়ে রাখে। কাবুলে তালেবান শাসন কায়েমের পর বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী, বিশেষ করে জামায়াত সন্ত্রাসের পথ ধরে। ঘোষণা করে—‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। বাংলাদেশে তখনই বাংলা ভাই, হিযবুত তাহ্রীর, জইশ-ই-মোহাম্মদ ইত্যাদি জঙ্গি গ্রুপ গড়ে ওঠে। শুরু হয় ব্যাপক সন্ত্রাস। গ্রামে পর্যন্ত এই জঙ্গিরা ইসলাম প্রচারক সেজে নারীদের বোরকা পরিধানে বাধ্য করে। তার ঢেউ শহরেও এসে লাগে। বাংলাদেশের সহিষ্ণু, উদার সমাজব্যবস্থায় ভাঙন ধরে। ধর্ম প্রচারের নামে আফগানিস্তান থেকে শত শত তালেবান পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে থাকে।
নাইন-ইলেভেনে নিউ ইয়র্কের ট্রেড সেন্টারে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে যায়। এই হামলার নেতা ওসামা বিন লাদেন ছিলেন জঙ্গি প্রতিষ্ঠান আল-কায়েদার নেতা। তিনি নিউ ইয়র্কে হামলার পরিকল্পনা করেছেন বলে অভিযুক্ত হন এবং নিখোঁজ হয়ে যান। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ সন্দেহ করে, লাদেন আফগানিস্তানে তালেবানের আশ্রয়ে আছেন। তালেবান সরকারের সঙ্গে আমেরিকার দোস্তি চলে যায়। শুরু হয় তালেবান সরকার উচ্ছেদে আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির যুদ্ধ। যুদ্ধে পরাজিত হতে থাকলে তালেবানের বহু সহচর পাকিস্তানে পলায়ন করে। বাংলাদেশে তখন পাকিস্তানের বন্ধুপ্রতিম বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। তাদের সম্মতি পেয়ে পাকিস্তান সরকার বাণিজ্য জাহাজ ভর্তি করে অনেক তালেবান সদস্যকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে দেয়।
তালেবান জঙ্গিদের একটা অংশের বাংলাদেশে পৌঁছানোর খবর পশ্চিমা বড় বড় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। বিএনপি-জামায়াত সরকার তাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়। বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশে তথাকথিত মুজাহিদদের অনুপ্রবেশ ঘটছে।
শেখ হাসিনার সতর্কবাণী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, শেখ হাসিনা দেশে জঙ্গি ঢুকছে, এই প্রচারণা দ্বারা দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করছেন। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার সুরে সুর মিলিয়ে দুই তবলা বেজে ওঠে। এই দুই তবলা হচ্ছে ঢাকার একটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক। বিএনপি-জামায়াতের অঘোষিত মুখপত্র। তারা একই দিনে ইংরেজি ও বাংলায় সম্পাদকীয় লিখে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাল, দেশে জঙ্গি ঢুকছে এই অসত্য প্রচার চালিয়ে শেখ হাসিনা বিদেশের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করছেন।
এর কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশ জঙ্গিতে ভরে যায়। উত্তরবঙ্গে শুরু হয় বাংলা ভাই ও এক শায়খুল হাদিসের দলের নারকীয় হত্যাকাণ্ড। দেশের তরুণসমাজের মধ্যেও জঙ্গিবাদ প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আহসানউল্লাহ মাস্টার ও কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড, ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদীদের নৃশংস ছুরি হামলা, পরিণামে তাঁর মৃত্যু আমেরিকার সরকারেরও টনক নাড়ায়। মার্কিন ফেডারেল ইন্টেলিজেন্সের গোয়েন্দা টিম আসে বাংলাদেশে। বিএনপি-জামায়াত সরকার বাধ্য হয় বাংলা ভাইদের ফাঁসি দিতে। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অজ্ঞাতপরিচয় এক বিরাট অংশকে ধরা সম্ভব হয়নি।
শেখ হাসিনার তিন দফার শাসনামলে এরাই বিএনপি-জামায়াতের সাড়ে তিন বছরব্যাপী মানুষ পুড়িয়ে মারার আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেছে। আমাদের পুলিশ ও র্যাবকে ধন্যবাদ, হাসিনা সরকারের আমলে এরা দুটি আধুনিক ফোর্স হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং দেশে সন্ত্রাস দমনে অনেকটাই সফল হয়েছে।
পুরনো কথার কাসুন্দি অনেকক্ষণ ঘাঁটলাম। সে জন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমা চাই। এই কাসুন্দি ঘাঁটলাম এ জন্য যে আফগানিস্তানের এই পুরনো তালেবান সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য আবার বড় দুর্দৈব হয়ে দেখা দিতে পারে। করোনা সমস্যায় জর্জরিত হাসিনা সরকার আরেকটি সমস্যা যে ধেয়ে আসছে তা হয়তো অনুধাবন করতে পারছেন। সমস্যাটি হলো, আফগানিস্তানে মার্কিন সহায়তায় মধ্যযুগীয় তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের দৃষ্টি প্রথমেই যাবে পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তানে তাদের হুকুমত সুপ্রতিষ্ঠিত হলে তাদের দৃষ্টি যাবে বাংলাদেশের দিকে। পাকিস্তান হয়ে নতুন জঙ্গি বাংলাদেশে পাঠানো শুরু হবে এবং বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিরা সক্রিয় হবে। তালেবান সরকারের অস্ত্র আসবে ভারত ও পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে। জামায়াতিদের পর হেফাজতিরা যে বাংলাদেশে মাথা তোলার চেষ্টা করেছিল তার কারণ সম্ভবত আফগানিস্তানই।
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনারা যে রণক্লান্ত তা নয়। কিন্তু লাদেনবিহীন তালেবান আমেরিকার শত্রু নয়। তাই আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সেনা মোতায়েন করে তাদের তত্ত্বাবধানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান, কাবুলে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা এবং এই সরকারকে সুরক্ষাদানের জন্য আফগান সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে আমেরিকা সব নৈতিকতাবর্জিত তালেবানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আফগান জনগণকে আবার এক বর্বর মধ্যযুগীয় শাসনের শিকল পরিয়ে যাচ্ছে। ১১ জুলাই সানডে টাইমসে তাদের প্রতিনিধি ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব খবর ছেপেছেন, তালেবানি শাসনের বর্বরতার ভয়ে কাবুল ও অন্যান্য শহর থেকে শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, হাসপাতালের নার্স, লেখক, সাহিত্যিকরা দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছেন। এই ভয়াবহ করোনার মধ্যে তাঁরা কোথায় পালাবেন? ক্রিস্টিনা ল্যাম্বের রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুদ্ধ করে তালেবান দেশের সামান্য অংশই দখলে রাখতে পেরেছিল। এখন পশ্চিমা সেনা সরে যাওয়ার সুযোগে দ্রুত শহরের পর শহর দখল করছে। কাবুলের উপকণ্ঠে এসে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন তাঁবেদার কাবুল সরকার তালেবানকে রোখার জন্য আফগানিস্তানের পুরনো গোত্র সর্দারদের হাতে আবার অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। এর পরিণাম পুরনো গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত।
আফগানিস্তানে এই অবস্থাটা তৈরি করে গেছেন সব গণ্ডগোলের মূল ট্রাম্প। তিনি মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখার জন্য দেশটি থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং তালেবানের হাতে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার সন্ধি করেছেন। ক্রিস্টিনা ল্যাম্বের রিপোর্টে বলা হয়েছে, তালেবান এখন আমেরিকাকে খুশি রাখার জন্য সন্ধি মেনে চলার ভান করছে। কিন্তু আফগানিস্তানে একবার তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে কী ঘটবে বলা মুশকিল।
পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশের এখনই সতর্ক হওয়া এবং সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র মৌলবাদ দমনে এখনই সতর্ক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। পুলিশ-র্যাব, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে সতর্ক রাখা আবশ্যক। তবে একটাই সান্ত্বনা, তালেবান ইসলামের কথা বলে। তারা আসলে ইসলাম নয়, কট্টর ওয়াহাবিজমে দীক্ষিত। ওয়াহাবিজম ইসলাম নয়, ইসলামবিরোধী মতবাদ। এই মতবাদের পৃষ্ঠপোষক এত দিন ছিলেন সৌদি বাদশাহরা। বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স সুলেমান ওয়াহাবিজম থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাব্যবস্থাকে অসাম্প্রদায়িক করা, নাচ-গানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে দেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেছেন।
আশা হয়, সৌদি আরব যদি কট্টর ওয়াহাবিজমের পথ ত্যাগ করে, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে অবস্থা হয়েছিল, সৌদি আরবে ওয়াহাবিজমের পতন হলে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গি নামে পরিচিত ওয়াহাবি টেররিজমেরও অবসান সূচিত হতে পারে। বাংলাদেশের জন্যও এটা হবে একটা বড় সুসংবাদ।