সেদিন কাগজে (কালের কণ্ঠ, ৯ জুলাই) দেখলাম লকডাউনের মধ্যেও টুকরি ও কোদাল নিয়ে অনেক শ্রমজীবী মানুষ রাস্তার পাশে বসে আছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে তারা জানিয়েছে যে এখন আর কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। বেঁচে থাকাই দায়। একজন জানিয়েছেন, সাত দিন ধরে তিনি কাজের সন্ধানে আসছেন। কিন্তু মাত্র দুই দিন কাজের সুযোগ পেয়েছেন। তিনি সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছেন, এই আয় দিয়ে কী করে তাঁর সংসার চলে। কী করে সরকারের দেওয়া ত্রাণ পাওয়া যাবে, কোথায় পাওয়া যাবে, তা তাঁরা জানেন না। এমন পরিস্থিতিতে এসব দুঃখী মানুষকে বাঁচানোর জন্য এক্ষুনি কিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারকেও বিপর্যস্ত জনগণকে কী করে ত্রাণ ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তার পর্যাপ্ত প্রচার করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। গতানুগতিক প্রচার নয়। আমি সামাজিক মাধ্যমসহ সব যোগাযোগ মাধ্যমকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে কী করে প্রকৃত দুঃখী মানুষের কাছে সরকারের সহায়তার বার্তাগুলো পৌঁছানো যায় সে বিষয়টির কথা বলছি।
নিঃসন্দেহে সরকারি কর্মকর্তা, সরকারগুলোর প্রতিনিধিদের, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিত্তশালীদের একযোগে কাজে নেমে পড়ার এটিই শ্রেষ্ঠ সময়। তারুণ্যের বিস্ফোরণেরও এটি উপযুক্ত সময়। তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে তাই আহ্বান করছি, তাঁরা যেন এসব দুঃখী মানুষকে কী করে ৩৩৩ নম্বরে যোগাযোগ করে খাদ্য সাহায্য পাওয়া সম্ভব, তা শিখিয়ে দেন। কী করে সরকারের ঘোষিত ত্রাণের খোঁজ পাওয়া সম্ভব, তা-ও পরিষ্কার করে বলার সময় যে বয়ে যাচ্ছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও চাইলে একটি আলাদা হাঙ্গার হটলাইন চালু করতে পারে। অথবা কেন্দ্রীয় ৩৩৩ হটলাইনের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্তি আরো শক্তিশালী ও কাস্টমাইজ করতে পারে। কোনো অবস্থায়ই মানুষ যেন খাবার না পাওয়ার মতো কষ্টের মধ্যে না পড়ে সেদিকে প্রশাসন ও সমাজকে নিরন্তর খেয়াল রাখতে হবে। একইভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই বা কী করছে, তা আরো প্রাঞ্জল ভাষায় বলার প্রয়োজন রয়েছে।
ব্যক্তি খাতের বড় বড় কম্পানি সরকারের ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া নানা ধরনের প্রণোদনার সুযোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু বিপৎকালে গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে সেভাবে এখন পর্যন্ত দাঁড়াতে দেখছি না। এমন দুর্যোগকালে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেওয়ার সুযোগ নিশ্চয়ই রয়েছে। সরকার ও সমাজ থেকে শুধুই নেবে এবং তেমন কিছু দেবে না, এমন ধারণাকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা নিশ্চয় তারা করবে, সেই প্রত্যাশা করছি। অস্বীকার করার উপায় নেই, সমাজ ও সরকার মিলেই এই দুর্যোগকাল পাড়ি দিতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আহ্বান করছি, তারা যেন এই দুঃসময়ে তাদের সিএসআর কার্যক্রম জোরদার করে এই দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। শুধু প্রতিষ্ঠান কেন, ব্যক্তিবিশেষেরও সামাজিক দায়বদ্ধ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, অনেকের বাসায়ই লকডাউনের সময় ছুটা গৃহকর্মীরা আসতে পারছে না। অনেক গাড়িচালকের কর্মচ্যুতি ঘটেছে। তাঁদের প্রতিও হূদয়বান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাঁদের যেন তাঁরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এই সময়ের প্রাপ্যটুকু সাহায্য হিসেবে পাঠিয়ে দেন।
এ ছাড়া সরকার এই সময়টায় এমন কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অবকাঠামো মেইনটেন্যান্সধর্মী পূর্তকর্ম হাতে নিতে পারে, যাতে শ্রমজীবী মানুষের খানিকটা হলেও কাজ মেলে। তাদের কাজের চাহিদা তৈরি করার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারগুলোকে করোনাকালে আরো সক্রিয় করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। জনপ্রতিনিধিদের কাছেই এখনো সাধারণ মানুষ সহায়তা ও সহযোগিতার জন্য যায়। তাই তাঁদের হাতে কভিড মোকাবেলার জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। এখন কিন্তু তাঁদের কাছে তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। অথচ অনেক অভাবী মানুষ তাঁদের কাছে আসছে। তাঁরা তাই বিব্রত বোধ করছেন। কয়েক দিন আগেই একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, নিজের সাধ্যমতো অর্থ জোগাড় করে কিছু অভুক্ত মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা তিনি করেছেন। তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তিনিই জানালেন, এ জন্য সিটি করপোরেশন বা সরকার থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ পেলে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের লোকহিত কাজ করা আরো সহজ হতো। এবারের বাজেটে বিরাটসংখ্যক উপজেলার শতভাগ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষকে বিভিন্ন ভাতার আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ কারণে প্রায় ১০ লাখ অভাবী পরিবারের বাড়তি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আসার কথা। স্থানীয় সরকার, সরকার, এনজিও, শিক্ষক ও স্থানীয় সমাজের গণ্যমান্য প্রতিনিধিদের নিয়ে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে এই নয়া উপকারভোগীদের তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে তা সামাজিক মাধ্যমের সহায়তায় ডাবল চেক করে নেওয়া সম্ভব। দ্রুত এই কাজটি করে ফেলে তাদের কাছে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সামাজিক সুরক্ষা ভাতা মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে নিশ্চয় দেওয়া যায়। সে জন্য দ্রুত অর্থছাড়ের ব্যবস্থা করা জরুরি। সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য এনজিও। তাদের সহযোগী করে অংশীদারির ভিত্তিতে সরকার ও স্থানীয় সরকার এবং বড় বড় করপোরেট হাউস এই দুর্যোগে মানুষের জীবন ও জীবিকা—দুটিই বাঁচাতে অনেক কিছু করতে পারে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনসহ অনেক স্বেচ্ছাসেবী ফাউন্ডেশন বা সংস্থা এই সংকটকালে তাদের সাধ্যমতো অভাবী মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এদের মতো সামাজিক সংস্থাগুলোকে আরো বেশি সিএসআর ও সামাজিক সমর্থন দেওয়ার জন্য যাদেরই সাধ্য আছে, তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। আটানব্বইয়ের বন্যার সময় দেখেছি, এ দেশের সামর্থ্যবান মানুষ কী বিপুলভাবেই না সহযোগিতার উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এই ঢাকার পাশেই বন্যার্তদের বাঁচাতে গিয়ে বেশ কয়েকজন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীকে প্রাণ দিতেও আমরা দেখেছি। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সময় শত শত স্বেচ্ছাসেবককে দিন-রাত পরিশ্রম করতে দেখেছি। সে সময় ব্যাংকগুলো আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য তাদের সিএসআর কর্মযজ্ঞের বিপুল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। আমি খুব কাছে থেকে তা দেখেছি। এমনকি সুদূর কাঠমাণ্ডুতে ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। শীতার্ত মানুষের, ছিটমহল ও চরে কষ্টে থাকা মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণে তারা উদারভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
এবারের দুর্যোগ তো আরো ব্যাপক। আরো প্রলম্বিত। আরো ভয়ংকর। এমন সময়ে তাদের এবং সমাজের বিত্তবানদের আরো বেশি করে এগিয়ে আসার কথা। এ সমাজই তো তাদের চাহিদা তৈরি করে। তাহলে সেই সমাজের বিপন্ন মানুষের পাশে তাদের দাঁড়ানোর কথা নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে কেন? শুনেছি, জাপানে সুনামির পর সে দেশের ব্যবসায়ীরা দিনের পর দিন তাঁদের কর্মী ও ভোক্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তেমন কোনো কর্মচ্যুতি ঘটাননি। এতে বরং পরবর্তী সময়ে তাঁদের ওপর ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। তাঁদের ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে। টেকসই হয়েছে। এই উদাহরণ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। ব্যবসায়ীদের করোনায় আক্রান্ত সমাজের জন্য আরো অনেক কিছুই করার আছে।
তবে আশার কথা, অনেক ব্যবসায়ী সংগঠন মানুষের জন্য অক্সিজেন ও খাবার জোগান দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছে। অভুক্ত মানুষের খাবার বিতরণে লেগে পড়েছে। বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণের কর্মসূচিকে আরো বিস্তৃত করছে।
তবে সময়টা যে বড়ই খারাপ। তাই আরো দ্রুত সবাইকে সামাজিক দায়িত্ববোধের অংশ হিসেবে দুঃখী মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। যত দিন বেশির ভাগ মানুষকে টিকা না দেওয়া যাচ্ছে, তত দিন সবাই যেন মাস্ক পরে এবং ভিড় এড়িয়ে চলে। এটিই এখন বাঁচার উপযুক্ত কৌশল। জেনে ভালো লাগল যে এফবিসিসিআইয়ের নয়া সভাপতি অচিরেই মানুষের মাঝে বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন। পুলিশের আইজিকেও মাস্ক পরার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলতে শুনলাম। এই কাজে সমাজের সংগঠিত সব শক্তিকে নেমে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সচেষ্ট সমাজই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।
আমাদের হাতে একেবারে সময় নেই। যুদ্ধাবস্থা মনে করে আমাদের সবাইকে মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর লক্ষ্যে সবাই যেন মাস্ক পরে, অভুক্তকে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় এবং সুযোগমতো মানুষ যেন টিকা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করাই এই সময়ের বড় দাবি। অতীতে বারবার দুর্যোগে, দুঃসময়ে জেগে উঠেছেন সাহসী মানুষ। আসুন, মানবতার ডাকে ফের জেগে উঠি। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই শ্রেষ্ঠ সময়কে আমরা কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারি না। আমাদের সামাজিক পুঁজিতে টান পড়েছে—এমন কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দরকার নির্ভরযোগ্য উদ্যোগের। তাই আসুন, যার যা আছে তাই নিয়ে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় অংশগ্রহণ করি। নিশ্চয় এই সংকটকেও আমরা সম্মিলিতভাবে রুখে দিতে পারব।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর