তালেবানরা আফগানিস্তানে সীমাবদ্ধ থাকবে তো?

এ কে এম আতিকুর রহমান

এ কে এম আতিকুর রহমান
এ কে এম আতিকুর রহমান

দুই দশক অবস্থানের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনাদের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। হয়তো মাস দু-একের মধ্যেই তাদের আফগানিস্তান ত্যাগ সম্পন্ন হবে। তালেবানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করা সমঝোতা অনুযায়ী মার্কিন ও ন্যাটো সদস্য দেশের সেনাদের এই প্রত্যাবর্তন। প্রশ্ন হচ্ছে প্রত্যাহারের পর পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে? এরই মধ্যে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের পরিণতি কী হবে? আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কি তা চলতে থাকবে; নাকি তালেবান জঙ্গিরা এই অঞ্চলের জন্য একটি স্থায়ী হুমকি হয়েই থাকবে? এমন করে ছেড়ে যাওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? এই মুহূর্তে এমন অনেক প্রশ্নই করা যেতে পারে।

আমরা একটু পেছনে ফিরে দেখি। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেখানে সোভিয়েত সেনাদের সঙ্গে ইসলামিক মুজাহিদীন যোদ্ধাদের যুদ্ধ চলতে থাকে। ওই অবস্থায় এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণে পরিবর্তন আনা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের আশঙ্কা ছিল, কখন যেন সোভিয়েত সেনারা সমস্যাসংকুল প্রদেশ বেলুচিস্তান দখল করে নেয়। তাই তিনি বিশেষ প্রতিনিধি পাঠালেন বন্ধুদেশ সৌদি আরবের বাদশাহর কাছে। এ ব্যাপারে মুজাহিদীন যোদ্ধাদের কাজে লাগানোর ধারণাটি উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই দুই বন্ধুদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে সম্মতি প্রকাশ করে। মুজাহিদীনদের জন্য পাকিস্তানে প্রয়োজনীয় অস্ত্র পাঠানো শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানের মাটিতে আফগান মুজাহিদীনদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। এভাবেই সৃষ্টি হয় জঙ্গিদের বাহিনী তালেবান।

১৯৯২ সালে সোভিয়েত সমর্থিত নজিবুল্লাহ সরকারকে তাঁবেদার সরকার আখ্যা দেওয়া হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও তালেবান জঙ্গিদের মাধ্যমে সেই সরকারকে উত্খাত করা হয়। অতঃপর ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেশ চালানোর জন্য স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তান একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তু ওই ভাগাভাগির সরকারও ব্যর্থ হয়, বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপের মধ্যে শুরু হয়ে যায় নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধ। এরই মধ্যে ওই অজুহাতে পাকিস্তানের পেশোয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের কাজটিও শেষ করা হয়।

তালেবান সদস্যরা মূলত মাদরাসার শিক্ষার্থী ছিল। আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পশতুন এলাকার মাদরাসার প্রায় ৫০ জন ছাত্র নিয়ে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে মোল্লা ওমর কান্দাহার শহরে তালেবান নামের সংগঠনটি গঠন করেন। ওই সময় পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া আফগান শরণার্থীদের মধ্যে মাদরাসার প্রায় ১৫ হাজার ছাত্র তালেবান বাহিনীতে যোগ দেয়। ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তালেবান যোদ্ধারা আফগানিস্তানের বেশির ভাগ এলাকা দখল করে নেয় এবং ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা করে।

২০০০ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নাইন-ইলেভেনের পটভূমিতে ২০০১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী তালেবানকে উত্খাত করে আফগানিস্তান দখল করে নেয়। ওই সময় বেশির ভাগ তালেবান নেতা তাঁদের আশ্রয়স্থল পাকিস্তানে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে পাকিস্তান তার মাটিতে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ তালেবান জঙ্গিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্রসমেত আফগানিস্তানে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া অনেক পাকিস্তানিকে, এমনকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও যুদ্ধের জন্য আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছে। পারভেজ মোশাররফ যখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ছিলেন তখন তিনি তালেবান তথা ওসামা বিন লাদেনের সহযোগী হয়ে যুদ্ধ করার জন্য কয়েক হাজার পাকিস্তানিকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের মার্চে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ বাংলাদেশ সফরকালে বলেছিলেন, বেলুচ ও পাখতুনদের ওপর পাকিস্তান নির্যাতন করছে এবং পাকিস্তানের ওই কার্যক্রমে আফগানিস্তান বসে থাকতে পারে না। কারণ ওই নির্যাতিতদের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে। বঙ্গবন্ধুও বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সংঘটিত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, বেলুচিস্তান নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের মনে সব সময়ই একটা ভীতি বিরাজ করছিল।

নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করায় তালেবান দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তারা এলাকার পর এলাকা দখল করে চলছে। তারা দাবি করছে, এরই মধ্যে আফগানিস্তানের ৮০ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এ ছাড়া দেশের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র কান্দাহার তাদের দখলে রয়েছে। সরকারি সেনারা তালেবানের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা আবার প্রতিবেশী দেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। তাজিকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া আফগান সেনার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আরেক প্রতিবেশী তুর্কমেনিস্তান তার সীমান্তে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান মোতায়েন করেছে।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তালেবানের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে আফগানিস্তানকে ছেড়ে দেওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? এটি কি সাধারণ দৃষ্টিতে আফগানিস্তানে তালেবান রাজত্ব কায়েমের সুযোগ দেওয়া? নাকি এ অঞ্চলে তালেবান যাতে নির্বিঘ্নে আরো জোরালোভাবে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারে তারই বীজ বপন করা? ওই পুরস্কারটি দেওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই বিশেষ কোনো চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে।

আমরা জানি, জন্মলগ্ন থেকেই তালেবানের পাশে সব কিছু নিয়ে দাঁড়িয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই তালেবানকে পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি হিসেবে তৈরি করাসহ সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর মদদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নাইন-ইলেভেন ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়। হঠাৎ করে এমন কী ঘটে গিয়েছিল যে ট্রাম্প সরকার সেই তালেবানের হাতেই আফগানিস্তানকে সমর্পণ করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে? নাকি পুরনো সম্পর্কটাকে স্মরণ করে যাওয়ার বেলায় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই উপহার দিয়ে গেল? না এ অঞ্চলের শান্তি ও উন্নয়ন বিঘ্নিত করার একটা চিরস্থায়ী উৎস রেখে গেল? তাহলে তো তালেবান নামের এ আগ্নেয়গিরির জঙ্গি উদগিরণ আশপাশের সব কিছু ভস্মীভূত করে ফেলবে।

পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক কেমন হবে—এই প্রশ্নের উত্তর কমবেশি সবারই জানা। পাশের দেশ চীন কি পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সূত্র ধরে আফগানিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্কের নতুন দিগন্তে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে? এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তান-পাকিস্তান-চীন ত্রিদেশীয় বন্ধুত্ব কতটুকু শক্তিশালী ও দৃঢ় হবে, এ মুহূর্তে বলা কঠিন। কারণ দুটি তালেবান পৃষ্ঠপোষণকারী দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক একটু অন্য রকমই হওয়ার কথা। তবে মিয়ানমারের বর্তমান জান্তা সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যেমন দৃঢ় তাতে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চীন চলতে পারবে বলেই মনে হয়, অন্ততপক্ষে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায়।

ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্ক ভালো হওয়ার পথটি তেমন আশাব্যঞ্জক হবে বলে মনে হয় না। এই দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালেবান যদি জঙ্গি দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তাহলে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে। পাকিস্তানে যে তালেবান স্থাপনা রয়েছে, সেগুলো যদি আফগানিস্তানের সমর্থনে কাশ্মীরে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা থাকে বা নেওয়া হয়, তা হবে অত্যন্ত সংঘাতময় পদক্ষেপ বা চিন্তা-ভাবনা। কারণ পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের জঙ্গিরা একত্র হলে এই অঞ্চলে যুদ্ধ আর ধ্বংস ছাড়া কিছুই থাকবে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, চীন-আফগানিস্তান সম্পর্ক আফগানিস্তানকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করতে কতটুকু ছাড় দেবে। কারণ আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি এসেই যায়।

বাংলাদেশ একটু দূরত্বে থাকলেও তালেবানের জঙ্গি থাবা বা আল-কায়েদার সন্ত্রাস কখনো যে বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করবে না, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আমরা যতই সজাগ থাকি না কেন, কখন কী যে ঘটে যায় বোঝা কঠিন। কয়েক দিন আগে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে একটি জঙ্গি আস্তানা থেকে বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ অনেক জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়। এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তারা বোমা তৈরির প্রশিক্ষক নব্য জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য বলে জানা যায়। এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা আগেও যে ঘটেনি তা নয়। তাই আমাদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, সন্দেহভাজন দেশি-বিদেশি প্রত্যেক মানুষের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং আফগানিস্তানে কখন কী ঘটছে তা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

তালেবান তাদের দেশকে সহিংসতা ও সন্ত্রাসমুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তর করুক, বিশ্বের শান্তিকামী প্রত্যেক মানুষই সে কামনা করে। তালেবান পেছনের জঙ্গি ইতিহাসের কালিমা ধুয়েমুছে শান্তির প্রস্রবণধারায় সিক্ত হয়ে নতুন মানুষ হয়ে উঠুক। তাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম বা কোনো ধর্মই জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকে সমর্থন করে না, সন্ত্রাস কখনো শান্তি আর উন্নয়নের সহায়ক হয় না। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আফগানরা শান্তিতে থাকুক, এই অঞ্চলের মানুষকেও শান্তিতে থাকতে দিক—এ প্রত্যাশাই রইল।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

শেয়ার করুন