প্রায় ত্রিশটির মতো কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলে বিপুল পরিমান টাকা লুটের ঘটনায় প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আরও ৩০টি মামলা করবে।
প্রতিটি মামলায় পিকে হালদারসহ ৭৫ জনকে আসামি করা হচ্ছে। আসামির মধ্যে আছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ১০ পরিচালক, এফএএসের ১০ পরিচালক, পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ ৪ বান্ধবীসহ ১২ আত্মীয়। শিগগির মামলাগুলো করা হবে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান পিকে হালদারসহ ৭৫ জনের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলার সুপারিশ করে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। তার নেতৃত্বে কমিশনের চার সদস্যের টিম দীর্ঘ তদন্তের পর এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
শুধু একটি কম্পিউটার ব্যবহার করে কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস লিজিং থেকে বিপুল এই টাকা লুট করে পিকে হালদার সিন্ডিকেট। কিভাবে রাতারাতি একইসঙ্গে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করা যায় তাও দেখিয়ে দিয়েছেন পিকে হালদার।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, আসামির তালিকায় উল্লেখযোগ্য ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাহিদ রুনাই, ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক, রাফসান চৌধুরী রিয়াজ, পরিচালক নুরুজ্জামান, নওশেরুল ইসলাম, বাসুদেব ব্যানার্জি, পাপিয়া ব্যানার্জি, নাসিম আনোয়ার, এমএ হাশেম।
এছাড়া তালিকায় নাম আছে এফএএসের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, ভাইস প্রেসিডেন্ট জাহাঙ্গীর আলম, মনিরুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেল শাহরিয়ার, পরিচালক মো. আবু শাহাজাদা, সোমা ঘোষ, অরুন কুমার কুন্ডু, পওদীপ কুমার রায়, বিরেন্দ্র কুমার সোম ও আতারুল আলম এবং পিএনএল ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান উদ্ভব মল্লিকের।
সূত্র জানায়, পিকে হালদার সিঙ্গাপুর, ভারত এবং কানাডায় প্রায় ছয়শ কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। পিকে হালদার কানাডার টরেন্টোতে মার্কেট কিনেছেন। সেখানে তিনি বিলাসবহুল বাড়ি গাড়ি ক্রয় করেছেন। তবে দেশি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে নিউজ হওয়ায় এবং তদন্তকারী সংস্থার বিভিন্ন তৎপরতায় পিকে হালদার গা ঢাকা দিয়ে থাকার চেষ্টা করছেন।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান শনিবার দুপুরে গণমাধ্যমকে বলেন, পি কে হালদার সিন্ডিকেট কাগুজে প্রতিষ্ঠান করে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হবে।
ঋণের টাকা লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে যায় পি কে হালদারের কাছে
তদন্তে দুদক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের প্রায় ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মর্টগেজ ছাড়াই প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি পূর্ণ ঋণ প্রদানের রেকর্ড পেয়েছে। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে তাদের ঋণ প্রদান করে কিভাবে সেই টাকা লেয়ারিংয়ের মাধ্যে পি কে হালদার সিন্ডিকেট আত্মসাত করেছে তার বিস্তারিত দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। এই সিন্ডিকেটে অন্তত ১২ জন পি কে হালদারের স্বজন-পরিজন। এছাড়া আছেন পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ চার বান্ধবী।
কাগুজে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে কনিকা এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, মুন এন্টারপ্রাইজ, জে কে ইন্টারন্যাশনাল, ফ্যাশন প্লাস লিমিটেড, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা এন্টারপ্রাইজ, ক্রসরোড করপোরেশন, মেরিন ট্রাস্ট, নিউটেক, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, দেয়া শিপিং লিমিটেড ও এমটিবি মেরিন লিমিটেড, আনান কেমিক্যাল ইন্টাষ্ট্রিজ লিমিটেড, কোলাসিন লিমিটেড, আর্থস্কোপ লিমিটেড, এমটিবি মেরিন, সুখাদা প্রোপ্রার্টিজ, সন্দীপ কর্পোরেশন, গ্রীন লাইন ডেভেলমেন্ট ও মেসার্স বর্ণ নামের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান। এই ধরনের প্রায় ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমান টাকা আত্মসাত করে পিকে হালদার সিন্ডিকেট।
এদিকে হাইকোর্ট ইতোমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং পিপলস লিজিংয়ের বোর্ড পূণর্গঠন করে দিয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন এফএএস ফাইন্যান্সের বোর্ড পূনর্গঠন করে দিয়েছে। নতুন বোর্ড কাজ করার পাশাপাশি ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। পরে এসব কোম্পানি থেকে ঋণের নামে বিপুল অংকের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেন।
এই চার কোম্পানি হলো- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
এর মধ্যে আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে গত বছরের শুরুতে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। তার মা লীলাবতী হালদারসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাইকোর্ট।