সাইমন ড্রিং এবং সাহসী সাংবাদিকতা

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ফাইল ছবি

সাইমন ড্রিং চলে গেলেন। কিংবদন্তি কথাটা আর ব্যবহার করতে চাই না। এটা বহু ব্যবহারে অর্থহীন হয়ে গেছে। তাই কিংবদন্তি কথাটা ব্যবহার না করে লিখছি সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার রূপকথার রাজপুরুষ। তাঁর জীবনে যত নাটকীয়তা ও বৈচিত্র্য তা রূপকথার রাজপুত্রদেরও ছিল না। কিন্তু রাজপুত্র ও সাইমন ড্রিংয়ের চরিত্রে একটা মিল ছিল। রাক্ষস বধের জন্য রাজপুত্র যেমন রাক্ষসদের প্রাণভোমরার খোঁজে অসম্ভব বিপদ পাড়ি দিয়ে সমুদ্রতলে পৌঁছেছিলেন, সাইমন তেমনি খাঁটি খবরের খোঁজে অসুর শাসকদের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করেছেন। কখনো বশ মানেননি। এমনকি বাংলাদেশে পাকিস্তানের বর্বর হানাদারদের কাছেও মাথা নত করেননি। তাঁর একটিই কথা ছিল, ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা।’ তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার আনত শিরের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সাইমন মারা গেছেন ১৬ জুলাই রোমানিয়ায়। হার্নিয়া অপারেশন করতে গিয়ে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সত্তরোর্ধ্ব বয়সে তিনি মারা গেলেন। আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু প্রতিভায় অনেক বড়। তাঁকে নিয়ে ঢাকার কাগজে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ঢাকার অনেক সাংবাদিক তাঁকে জানতেন। তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য তাঁদের হয়েছে। তাঁরা অনেকেই তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন। তাঁর জীবনবৃত্তান্তও প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার সব কাগজেই। তাই সেসব কথা আবার নতুন করে লিখতে গেলাম না। তাঁর সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল সামান্যই। কিন্তু গড়ে উঠেছিল গভীর অন্তরঙ্গতা। তাই এখানে তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু কথা লিখব।

সাইমনের সঙ্গে আমার আলাপ ঢাকায় একাত্তরের সেই ঝোড়ো দিনগুলোতে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক পিটার হেজেলহার্স্ট ঢাকায় এসেছিলেন একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসেই। ঢাকায় অবস্থানের ৯ দিনের মাথায় তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফে রিপোর্ট পাঠালেন—‘নাইন ডে’জ জাঙ্গল-রুল ইন ইস্ট পাকিস্তান’। তিনি অবজারভার হাউসে এসেছিলেন। আমি তখন অবজারভার হাউসের বাংলা দৈনিক পূর্বদেশে (এখন নেই) কাজ করি। হেজেলহার্স্টের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি আমার পরিচয় জেনে তাঁকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন।

আমি তাঁকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে হেজেলহার্স্টই জানালেন, তাঁর আরেকজন সহকর্মী সাইমন ড্রিং আগেই ঢাকায় এসে গেছেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আপনারা অনেক বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় আসছেন। ব্যাপার কী? আপনারা কি ঢাকাকে নেক্সট ট্রাবল স্পট মনে করেন?’ হেজেলহার্স্ট বললেন, ‘আমার তা-ই ধারণা। নইলে সাইমন ড্রিং ঢাকায় আসতেন না। তিনি ভিয়েতনামে একবার, আরেকবার সাইপ্রাসে রণাঙ্গনের রিপোর্ট করতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি আশা করছি, এবার ঢাকায় তেমন কিছু হবে না, আমরা একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছতে পারব। নইলে পরিস্থিতি ভিয়েতনামের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে।’

সায়মন ড্রিং
সাইমন ড্রিং

মার্চ মাসের শুরুতেই বিদেশি সাংবাদিকরা দলে দলে ঢাকায় এসে পৌঁছান। তাঁদের আবাসস্থল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। সাইমন ড্রিংও এসে এখানেই উঠেছিলেন। তিনি রয়টার, বিবিসি থেকে শুরু করে বিশ্বের বেশির ভাগ সংবাদ সরবরাহ সংস্থা ও সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। তখন সম্ভবত টাইমসে কাজ করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। পরিচয় হতেই দুজন দুজনের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক যখন শেষ পর্যায়ে, অত্যন্ত ক্রুসিয়াল পর্যায়ে, আওয়ামী লীগ নেতারা তখনো আশা করছেন একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতা হবে, তখন সাইমন একদিন অবজারভারের মূসা ও আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা সমঝোতা হবে না। আমি করাচি হয়ে ঢাকায় এসেছি, পিন্ডির এক ক্লাবে মদ খেয়ে অর্ধমাতাল জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বলতে শুনেছি, মুজিবকে এবার আমি ছেড়ে দেব না। নির্বাচনে জিতলে কী হবে, এবার ব্যালট নয়, বুলেট দিয়ে কথা বলা হবে।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বুলেটের চেয়ে ব্যালট যে শক্তিশালী, এবার প্রাণ দিয়ে হলেও আমি তা প্রমাণ করব।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কার কথা সত্য হয়েছিল।
সাইমন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন ১৮ বছর বয়সে। আমিও তাই। তাঁর পটভূমি ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আমার ছিল পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ। তিনি ঢাকায় এসে ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে পেলে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ ও ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা রায়ট সম্পর্কে জানতে চাইতেন। সাইমন ব্রিটিশ সাংবাদিক। কিন্তু অকপটে স্বীকার করতেন, ব্রিটিশ শাসিত বাংলাদেশে বাংলা পঞ্চাশ সনের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি। এই দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ নর-নারীর মৃত্যুর জন্য চার্চিল দায়ী। সাইমনের অভিমত, ছয় লাখ থেকে ১০ লাখ ইহুদি হত্যার জন্য হিটলারের যদি বিচার হতে পারে, তাহলে ৫০ লাখ বাঙালি হত্যার জন্য চার্চিলের বিচার হবে না কেন?

জিজ্ঞেস করেছি, আপনার এই অভিমত কখনো প্রকাশ করেছেন? সাইমন বলেছেন, ‘করেছি। সে জন্য নিজের দেশেই নিন্দিত হয়েছি এবং প্রশংসিতও হয়েছি।’ এটা পরবর্তীকালের কথা। ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর রেজা শাহ দেশ ছেড়ে পলায়ন করেন এবং ইসলামী বিপ্লবের নেতা আল্লামা খোমেনি ১৪ বছর প্যারিসে নির্বাসনে কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তরুণ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং একই প্লেনে তাঁর সঙ্গে প্যারিস থেকে তেহরানে পৌঁছেছিলেন। আমার এই আল্লামা খোমেনি সম্পর্কে লন্ডনে বসে জানতে প্রচণ্ড ইচ্ছা হয়েছিল। এই খোমেনির এক ফতোয়ার জন্য একসময় বিশ্ব বিখ্যাত লেখক সালমান রুশদিকে বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলো সালমানকে রক্ষার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে বাধ্য হয়েছিল। আমার কাছে দাড়িওয়ালা এক মোল্লার ক্রূর কঠিন চরিত্রের যে ভাবমূর্তি, সেই ভাবমূর্তিই খোমেনি সম্পর্কে মনে স্থায়ী হয়েছিল। বাংলাদেশে বিএনপির রাজত্বকালে সাইমনকে যখন বের করে দেওয়া হয়, তখন তিনি দুই দিনের জন্য লন্ডনে এসেছিলেন। সানডে টাইমস অফিসে তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ-টাইম বৈঠক। তখনই খোমেনির কথাটা কথা প্রসঙ্গে উঠেছিল।

সাইমন বললেন, ‘চৌধুরী, আপনার ধারণা ভুল। বাইরের জগতে তাঁকে যে কট্টর চেহারার দেখানো হয়েছে তিনি তা নন। কট্টর মোল্লা মোটেই ছিলেন না। আমার হাতে ড্রিংসের গেলাস দেখে তা সরিয়ে ফেলতে বলেননি। বিমানে পাশের সিটে বসিয়ে ইসলামী বিপ্লবের আদর্শ ও উদ্দেশ্য আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।’

তিনি বলেছেন, মানুষ এবং মানুষের সমাজ যেমন পরিবর্তনশীল, তাদের ধর্মও তাই। পনেরো শ বছর আগের ইসলামী সমাজের বিধিব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে রাখলে চলবে না, তাকে যুগোপযোগী হতেই হবে। তবে ধর্মের যে বেসিক মন্ত্র তা থেকে সরলে চলবে না। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, হাউস অব সৌদ বেশিদিন টিকবে না। পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যাবে।

সাইমন ড্রিং বাংলাদেশ থেকে দুইবার বহিষ্কৃত হয়েছেন। একবার ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হানাদারদের দ্বারা। দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিএনপি সরকারের আমলে এবং তাদের হুকুমে। সাইমনের ভাষায়, ‘তাঁকে প্রথমবার বহিষ্কার করেছিল পাকিস্তানিরা, পরে তাঁকে বহিষ্কার করেছিল পাকিস্তানের তাঁবেদাররা।’ একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদাররা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে ধরে নিয়ে প্রায় ২০০ বিদেশি সাংবাদিককে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করে। সাইমন হোটেল থেকে পালিয়ে যান। ২৭ মার্চ ভোরে কারফিউ শিথিল করা হলে তিনি সেই সুযোগে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঢাকা শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। শেষ পর্যন্ত ব্যাংককে পালিয়ে যেতেও সক্ষম হন। সেখান থেকেই ঢাকায় পাকিস্তানি বর্বরতার রিপোর্ট প্রথম বহির্বিশ্বে প্রকাশিত হয়। ওই রিপোর্টের হেডিং ছিল, ‘Tank crush revolt in pakistan’. রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে।

সাইমন ড্রিং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিত্র বাহিনীর সঙ্গে ময়মনসিংহ দিয়ে আবার বাংলাদেশে ঢোকেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আগেই পরিচয় হয়েছিল। এবার তা ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। তৃতীয়বার সাইমন বাংলাদেশে আসেন একুশে টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা এ এস মাহমুদের আমন্ত্রণে। টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কে বিস্ময়কর পরিবর্তন আনেন। এবারও তাঁর এবং বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, সাইমনের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার প্রভাব দেখে খালেদা সরকার তাঁকে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করে। একুশে টেলিভিশনের মতো এত উচ্চমানের টিভি সেন্টারটি তারা ধ্বংস করে। এর পরও সাইমন বাংলাদেশে এসেছেন যমুনা টিভির উপদেষ্টা হয়ে। হাসিনা সরকার তাঁকে উপযুক্ত সম্মানও দেখিয়েছিল।

দ্বিতীয়বার সাইমন বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে এসে যখন লন্ডনে এসেছিলেন দুদিনের জন্য, তখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, সে কথা আমি আগেই লিখেছি। সেবার সাইমন আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের যত বর্বরতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নিজের দেশের স্বৈরাচারী শাসকদের বেশি বর্বরতার সম্মুখীন হয়েছেন। সাইমন আরো বলেছেন, ‘আমি ২২টি দেশের যুদ্ধ ও বিপ্লব দেখেছি। ইদি আমিন আমাকে বন্দি করে রেখেছিল; ভিয়েতনামে, সাইপ্রাসে দুইবার মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচেছি, পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। সব বিবেচনায় বাঙালির ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অভিবাদন জানাই। বাংলাদেশকে আমার দ্বিতীয় স্বদেশ মনে করি।’ সাইমনের সঙ্গে ওই আমার শেষ দেখা।

শেয়ার করুন